Bangla
2 years ago

শংকরের জন অরণ্য : টিকে থাকার লড়াই

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

 'হে আমার দেশবাসিগণ, আমি স্বীকার করতে রাজি আছি, তোমরা অনেক কিছুরই খবরাখবর রাখো না। কিন্তু এই বই পড়ার পর তোমরা আর বলতে পারবে না, নির্লজ্জ শোষণ এবং অন্যায়-অবিচারের খবর তোমাদের জানানো হয় নি।'

- জ্যঁ পল সাঁত্রে 

অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে সংগ্রাম করে পড়ালেখা চালিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানুষের গল্পের সাথে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এমন যদি হয় গল্পটা কোনো পরাজিত সৈনিকের? মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, গড়পড়তা রেজাল্ট কিন্তু কিছুতেই চাকরির দেখা মিলছে না।

সত্তরের দশকের কলকাতা। বেকারদের ছড়াছড়ি। কর্মক্ষম লাখ লাখ যুবক। আড়াই বছর ধরে চাকরির এ্যাপ্লিকেশন লিখে দিন পার করছে উপন্যাসের মূল চরিত্র সোমনাথ ব্যানার্জী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান সোমনাথের বন্ধু সুকুমারও খুঁজে চলেছে চাকরি। কিন্তু চাকরি কোথায়? 

কলেজ জীবনে কবিতা লেখবার সুবাদে সোমনাথের পরিচয় হয় তপতীর সাথে। তপতী ভালোবাসে সোমনাথকে। একদিকে বরাবর ভালো ফলাফল করা তপতী স্কলারশিপ পেয়ে গবেষণা করছে। অন্যদিকে হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজা বেকার সোমনাথ দাঁড়াতে পারছে না তপতীর সামনে।  নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক সংস্কার সমস্তকিছু ভুলে একটা সময় সোমনাথ নামে ব্যবসায়। কিন্তু কী হয় এরপর? 

জন অরণ্য বলতে রূপকার্থে কলকাতা শহরকে বোঝানো হয়েছে যেখানে কেউ বিনা যুদ্ধে সূচের আগার পরিমাণ মাটিটুকু ছাড়ে না। এই জনঅরণ্যের অলিখিত নিয়ম - "হয় খাও নয়তো খাদ্য হও" এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখতে হয় সোমনাথকে। টিকে থাকার লড়াইয়ে যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার দৌড়ে শামিল হয় সোমনাথ ব্যানার্জী। সৎ থাকা নাকি সুখী থাকা? মানবতা নাকি খাওয়াপরা? নৈতিকতার সাথে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সমাজের তথাকথিত সফলতার সাথে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব লেখক তুলে ধরেছেন দারুণভাবে। 

১৯৭৩ সালের দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয় শংকরের ‘জন অরণ্য’ উপন্যাসটি। ঐদিনই উপন্যাসটি পড়ে সত্যজিৎ রায় ফোন করেন লেখক শংকরকে। বইটির কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছার কথা জানান তিনি৷ পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে সত্যজিত রায়ের ‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। 

পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা ত্রয়ীর শেষ চলচ্চিত্রটি হচ্ছে জন অরণ্য; প্রথম এবং দ্বিতীয়টি প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০) এবং সীমাবদ্ধ (১৯৭১)। কলকাতা ত্রয়ীকে অনেকে রাজনৈতিক ত্রয়ী বলেও অভিহিত করে থাকেন কেননা এই তিনটি ছবিই ষাট-সত্তর দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে। জনঅরণ্য চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথের বাবার ভূমিকায় সত্য বন্দোপ্যাধায় এবং তপতীর চরিত্রে অপর্ণা সেন। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিপঙ্কর দে ,আরতি বন্দোপ্যাধায়, গৌতম চক্রবর্তী, লিলি চক্রবর্তী, উৎপল দত্ত। 

সত্তরের দশকের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার পটভূমিতে চলচ্চিত্রটির সূচনা । শুরুতেই দেখা যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অনার্সের বিশৃঙ্খলা পরীক্ষার হল যেখানে দেয়াল জুড়ে ঠাসা বিপ্লবের বাণী : ‘সশস্ত্র বিপ্লবই সর্বহারাদের একমাত্র পথ’, ‘শ্রেণীশত্রু খতম করো’, ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করো (CPI (ML)।  অথচ সেখানে মূল্যবোধ শিকেয় তুলে চলছে নকলের অবাধ আদানপ্রদান, কেউ মানছে না শিক্ষকের কোনো কথা। 

এরকম এক দৃশ্যের অবতারণা করে সত্যজিত রায় বামপন্থী আন্দোলন এবং মতাদর্শে বিশ্বাসীদের নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ের এক পরষ্পরবিরোধী দৃশ্যকে করুণভাবে চিত্রায়িত করেছেন।একদিন হঠাৎ বাজার করে ফেরবার পথে কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে যাবার সময় সোমনাথের দেখা হয় বিশুদার সাথে৷ এই বিশুদাই তাকে ব্যবসার বুদ্ধি দেয়। কলার খোসায় পা পিছলে যাওয়াকে আক্ষরিক এবং নৈতিকভাবে পদস্খালন হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন পরিচালক। মিস্টার গোয়েংকার সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখবার জন্যে বেকার সোমনাথের নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত  হয়ে ওঠবার পরই চলচ্চিত্রের পর্দায় বেজে ওঠে ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।’

সত্যজিতের ছবিতে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, বেকারত্ব, খাদ্যসংকট, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধঃপতন এসমস্ত শহুরে বাস্তবতা উঠে না আসার যে কথা চলচ্চিত্র সমালোচকরা বলে থাকেন, ১৯৬৯-১৯৭৫ এর মধ্যেকার ‘কলকাতা ত্রয়ী’ সে ধারণা বদলে দিতে বাধ্য৷

উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রের মূল ঘটনা এক হলেও শিল্প মাধ্যমের ভিন্নতার কারণে ঘটনাপ্রবাহে কিছুটা অমিল দেখা দিয়েছে বটে। উপন্যাস জুড়ে সোমনাথের বন্ধু সুকুমারের বেকারত্ব, দারিদ্রপীড়িত পরিবার যতটা নিদারুণ অসহায়ত্বে বর্ণনা করেছেন লেখক, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ঠিক ততটা দেখা যায় না। আবার তপতীর সাথে সোমনাথের পরিণতিও উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে ভিন্ন ভিন্ন।  

‘জন অরণ্য’ টিকে থাকার এক করুণ আখ্যান যেখানে সমাজ বাস্তবতার সাথে ধেয়ে চলা মানুষেরাই জিতে যায়, বেঁচে যায়। কিন্তু রয়ে যায় এক বঙ্কিম প্রশ্ন। জনঅরণ্যের আদিমতম সংগ্রামের এই বেঁচে থাকাই কি কাঙ্ক্ষিত বেঁচে থাকা? আত্মা না বাঁচলে দেহ যে বাঁচে না!

banushka0322@gmail.com

শেয়ার করুন