Bangla
2 years ago

শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত নানী-দাদীদের ঘুম পাড়ানি শ্লোক

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

আয় ঘুম, যায় ঘুম 

যোগীপাড়া দিয়া। 

যোগীর মা কাপড় বুনায় 

লাল সুতা দিয়া। 

ও সুতা ভালো না 

ও কাপড় পরবো না।

-------

ভুত্তুম, ভুত্তুম!

ভুত্তুম গাছের তলে,

ভুত্তুম নিলো চিলে,

একটা ভুত্তুম পাইছিলাম,

পানি কুড়াইবার গেসিলাম,

ভুত্তুম এখনো তাজা,

আমার ময়না হবো রাজা!!!

 

লাইনগুলো মনে করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া এক সোনালি শৈশব যখন নানী-দাদীদের কাছে আমরা বায়না ধরতাম এসব ছন্দ আর কবিতা শোনার জন্য। ঠাকুমারা নিষিয়েই তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে বানিয়ে ফেলতেন ছন্দ। রাতের বেলা তাদের কাছে এই আবদার না করলে ঘুমই আসত না যেন। মানুষের স্মৃতিতে সেসব ছড়া/শ্লোক/ছন্দ আজও বেঁচে আছে। 

মূলত শব্দের সাথে শব্দ মিলিয়ে এই ছন্দ তৈরি করতেন তারা। তাদের এই ছন্দে পশু, পাখি, ফুল, গাছ, প্রকৃতি, মানুষ সবই থাকত। জীবনের সাথে সম্পর্কিত ও পরিচিত সব ঘটনা জুড়েই তারা বানাতেন ছন্দগুলো যাতে থাকত নিজস্ব আবেগ। ছন্দের অতিপ্রাকৃতি বিষয়বস্তুই ছিল খুদে শ্রোতাদের মূল আকর্ষণ।

এই ছন্দ আর শ্লোকগুলো বাংলার প্রায় প্রতিটা অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল। এমনই কিছু শ্লোক আর ছড়া একত্র করা হয়েছে এই লেখায়, যা আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে।

 

জল কই, ডাউকে (ডাহুক) খাইছে,

ডাউক কই, জঙ্গলে গেছে,

জঙ্গল কই, পুইড়া গেছে,

ছাই মাড়ি (মাটি) কই, উইড়া গেছে 

 

গঙ্গীরে গঙ্গীরে লেডুরা

মহিষের সিং কাডুরা

মহিষের তেলে তেরাগ বাত্তি জলে

গুয়ের গাংগে যাইবে নাকি চিনির গাংগে যাইবি?

চিনির গাংগে

চিনির গাংগে বললে ডান পাশে ফালায় দিত ধপাস করে।

 

এই ছড়াটি শেষে বিছানায় ফেলে দেয়াই ছিল আসল মজা। এমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রচলিত একটি জনপ্রিয় ছন্দ ছিল- 

 

জল্লোই জল্লোই 

মামুর বাড়ি কল্লোই

মামু গেছে মাছ মারতে

চিলে দিসে থাপা

ও চিল বিলো যা

বড় বড় কৈ ধইরা খা। 

 

তারপর জিজ্ঞেস করতো কোন গাঙে পরবা? চিনির গাঙ্গে নাকি লবনের গাঙ্গে? দুইটা থেকে একটা বেছে নিলেই ডানে অথবা বামে ফেলে দিতেন নানী দাদীরা।

আবার শরীয়তপুরে এমন একটি ছন্দ আছে -

 

বাড়ুই বাড়ুই! ফিরি চাচি,

কৈ গেছিলা? ঝাকার তলা,

কি দেইক্কাইলা? হৌলের পোনা,

ধরলা না ক্যা? গ্যারা গ্যারা।

হাতে কি? বাঁশি

বাজাও না ক্যান? মুখে ঘাও

একটু বাজাও,প্যাঁপু প্যাঁপু

সোনার ধারে পরবা, না রুপার ধারে?

 

সোনার ধার বললে ডানপাশে আর রুপার ধার বললে বাম পাশে ফেলে দিতেন তারা। ফেনিতে একটি শ্লোক প্রচলিত ছিল- 

 

টুক্কু টুক্কু বালা, 

বসিরা শালা।

বসিরা বাইরে, 

চিরা দোকা খাইরে। 

চিরাত কা ধান,

চুলে ধরি আন।

চুল কা কালা, 

নাক কাডিয়া হেলা।

নাকের রক্ত, 

ভাইয়ার বৌ শক্ত।

ভাইয়ায় দিলো দুয়ানি

ভাবিয়ে দিলো গাইল। 

 

আবার বরিশালে একটি শ্লোক ছিল -

 

ঘুগুসই, ও দাদান,

খুদ খাইতে মালই আন।

মালই নেছে হোতে,

ঝুপটি ধইরা কোঁতে।

মোগো মনুর বিয়া,

নলের আগায় টিয়া।

ছোড তালগাছটা নড়েচড়ে,

বড় তালগাছটা ঝুপ্পুত।

 

নোয়াখালী এদিকেও পিছিয়ে ছিল নাহ।তাদের এলাকায় ছিল -

 

বারই গো বারই

দা কান ল,

দা দি কিরবা?

বাঁশ কাডুম।

বাঁশ দি কিরবা?

খাঁচা বানামু।

খাঁচা দি কিরবা?

বো রাখুম।

বো দি কিরবা?

বিয়া করামু,

খাওয়ামু, হরামু, ঠ্যাঙের আগাত তুলি নাচামু।

 

এরপরে বাচ্চাকে উপরে তুলে বিছানাতে ফেলে দিত। ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল একটি শ্লোক-

 

অলো লোলিরে

বান্দা লোলির ছাও 

পাইল্যা লুইল্যা বড় করলাম 

হরিণ ধইরা খাও!

 

অপুর নানী খাড়াইয়া রইছে দুধের বাটি নিয়া 

অপুরে যে নিতে আইছে খাট-পালং দিয়া!

অপু ঘুমা রে, ঘুমা তাড়াতাড়ি

বাড়ির পিছে হিয়াল-কুকুরে লাগছে দৌড়াদৌড়ি! 

 

ময়মনসিংহে আরো একটি শ্লোক ছিল -

 

বাবুইরে বাবুই, গাছে উঠছোস ক্যারে?

-বাঘের ডরে।

বাঘ কই?

-ছালি-মাটির তলে।

ছালি কই?

-গাঙে ভাসাইয়া দিছে।

গাঙের মাছ কই?

-কৌড়ালে (পানকৌড়ি পাখি হয়তো) খাইছে।

কৌড়াল কই?

-ডালো।

ডাল কই?

-ফুতাটুনি নিছে। (ফুতাটুনি= যে ঘুরে ঘুরে সুতা সংগ্রহ করে এমন কেউ হয়তো)

ফুতাটুনি কই?

-গাঙে ভাসাইয়া দিছে।

কোন গাঙে, ছোট গাঙে না বড় গাঙে?

 

তারপর ছোটো গাঙে বললে একপাশে ফেলে দিতো, আর বড় গাঙে বললে অন্য পাশে। 

উত্তরবঙ্গে বেশকিছু শ্লোক ও ছন্দ প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে ফরিদপুরে বেশ কিছু জনপ্রিয় ছন্দ প্রচলিত ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো -

 

গেকুকরুস কুক

আলীম চা

পাতারোত ব্যাঙ

মামা কই মাছে গেছে

মাছ কই, চিল নিগাইছে

চিল কই, ঠ্যালে পড়ছে

ঠ্যাল কই বাড়ি গেছে

বাড়ি কই, পুড়ি গেছে

ছাই কই, উড়িয়া গেছে

 

ঘুঘু ঘুঘু বারা বান

বানছি চাইরডা উদা ধান।

খুদ খাস তো নড়ই আন

নড়ই ধইর‍্যা দিলাম টান।

চান্দের মা লো বুড়ি

খড়ি কুরাবার গেলি

সাতখান কাপড় পাইলি 

ছয় বউকে দিলি

তুই একখান নিলি 

বড় তালগাছ টা নড়েচড়ে 

ছোটো তালগাছটা 

ঢ্যাপুস হয়ে পড়ে।

 

আবার কুমিল্লায় প্রচলিত ছিল, অনেকটা প্রশ্ন-উত্তর এর মতো করে -

 

গাঙুরে গাঙু!

- কিরে গাঙু?

কিদ্দা খাইছস?

- মাছ দিয়া।

আর কিদ্দা?

- ডাল দিয়া।

আর কিদ্দা?

- আলু দিয়া।

আর কিদ্দা?

 

এছাড়াও রাজবাড়ীতে প্রচলন ছিল -

 

হাপুসই, ঘুঘুসই

মনা কই? তালগাছে

তাল কই? চিলে নেছে

চিল কই? উইড়ে গেছে

চিলের নাগাল পালাম না

তালের বড়া ভাজা খালাম না।

 

তারপর, 

ধোপার নাচন, কাপড় কাচন

ধোপার নাচন, কাপড় কাচন 

 

বলে পায়ের ওপর শিশুকে দোল দিতে দিতে বলা হতো, “ও ধোপা, সুনার পুকুরে পরতি চাও না রুপার পুকুরে?” 

বলে বিছানার একদিকে ফেলে দেয়া হতো।

নাওশিন মুশতারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। 

nawshinmushtary38@gmail.com

শেয়ার করুন