Bangla
3 months ago

সুইস ব্যাংকে কারা টাকা জমা রাখতে পারে?

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

সুইস ব্যাংকের নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বিভিন্ন কারণে গণমাধ্যমের শিরোনামে থাকে এই ব্যাংক। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যতটা না ইতিবাচক, তার চেয়ে বেশি নেতিবাচক ভূমিকায় দেখা যায় সুইস ব্যাংককে।

দূর্নীতি, অর্থ পাচার কিংবা অবৈধ অর্থে সম্পদের পাহাড় গড়া- এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই নাম জড়ায় সুইস ব্যাংকের। তাই তো কৌতূহলোদ্দীপকভাবেই এই ব্যাংকটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে মানুষের। সুইস ব্যাংক কী, এটি কীভাবে কাজ করে অথবা কারা এই ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারে- ইত্যাদি প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরপাক খায় মানুষের মনে।

সুইস ব্যাংক বলতে মূলত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বোঝায়। কোনো একটি একক ব্যাংকের পরিবর্তে দেশটির সকল ব্যাংকই সুইস ব্যাংকের আওতাভুক্ত। এটি মূলত একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা গ্রাহকের আর্থিক তথ্যাবলি কঠোর গোপনীয়তার সাথে সংরক্ষণ করে। এমনকি গোপনীয়তা রক্ষার নিমিত্তে আইনও প্রচলিত আছে সুইজারল্যান্ডে যা সুইস ব্যাংকগুলোকে মানুষের বিশ্বাস ও ভরসার জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।

তবে এই ব্যাংকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে টাকা জমা রাখলে কোনো ধরনের সুদ বা লভ্যাংশ পাওয়া যায় না। বরং আমানতকারীকে তার হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যাংককে খরচ বা চার্জ দিতে হয়।

এতো কিছুর পরেও সুইস ব্যাংকের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী আকাশচুম্বী। মূলত আর্থিক লেনদেনের গোপনীয়তা বজায় থাকে বিধায় অনেকে তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের দূর্নীতিবাজরাও তাদের অবৈধ অর্থের লেনদেন গোপন রাখতে বেছে নেয় সুইস ব্যাংগুলোকে।

সুইস ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় তিনশত বছর আগে। সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ রক্ষার উদ্যোগ থেকে যাত্রা শুরু হয় সুইস ব্যাংকের।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সুইস ব্যাংকগুলো মানুষের নজরে আসতে শুরু করে। কারণ, সেই সময় অনেক দেশ তাদের যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে জনগণের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো শুরু করে। সুইস ব্যাংকে যেহেতু আমানতকারীর লেনদেনের তথ্য গোপন রাখা হয়, তাই অতিরিক্ত করের বোঝা থেকে বাঁচতে অনেকে সেই সময় সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রাখা শুরু করে।

সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট জাতি কিংবা গোত্রের উপর কোনোরূপ বিধি-নিষেধ নেই। বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখার মাধ্যমে যে কেউই এখানে একাউন্ট খুলতে পারে।

সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে আমানতকারীকে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনেও এই সেবা গ্রহণ করা যায়। সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে গেলে পাসপোর্টসহ আরও নানাবিধ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা রাখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ওইসিডির (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) সরাসরি নজরদারিতে থাকে সুইস ব্যাংকগুলো।

আপনি যদি কোনো সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে চান তাহলে সর্বনিম্ন ১০ হাজার সুইস ফ্র‍্যাঁ জমা রাখতে হবে বাংলাদেশী মুদ্রায় যার বর্তমান মান প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। তবে ব্যাংকভেদে এটি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেহেতু এখানে আমানতের বিনিময়ে গ্রাহক কোনো সুদ পান না বরং হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংককে দিতে হয়, তাই এখানে সুদহার ঋণাত্নক হয়ে থাকে।

সুইস ব্যাংকে গ্রাহকের হিসাবের গোপনীয়তা রক্ষা করা সুইজারল্যান্ডের আইন দ্বারা স্বীকৃত। এসব আইন আসার পেছনেও রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে ফ্রান্স ও জার্মান সরকার সুইস ব্যাংকে জমা রাখা তাদের দেশের মানুষের অর্থের খোঁজ করতে শুরু করে। এসময় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় তারা। ১৯৩২ সালে ফ্রান্সের পুলিশের হাতে সুইস ব্যাংকের দুইজন কর্মকর্তা গ্রেফতার হলে বহু আর্থিক তথ্য বের হয়ে আসে।

পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে গোপনীয়তা সংক্রান্ত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে সুইজারল্যান্ড সরকার যার অধীনে তথ্য কিংবা গোপনীয়তা ফাঁসকে দেওয়ানি অপরাধের পরিবর্তে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই আইনের অধীনে তখন থেকে তথ্য ফাঁসের শাস্তি ছয় মাসের কারাদন্ড থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয় এবং সেই সাথে জারি হয় অর্থদন্ডও। এছাড়া কোনো সাংবাদিক যদি তথ্য ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকেন সেক্ষেত্রে তিনিও শাস্তির মুখোমুখি হবেন।

তবে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকদের কাছে সুইস ব্যাংক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৮৪ সালে সুইস ব্যাংকের জন্য গৃহীত আইন পরিবর্তন করতে হবে কিনা এমন একটি গণভোট আয়োজিত হয়েছিল সুইজারল্যান্ডে। সেখানে ৭৩% মানুষ আইন সংশোধনের বিপক্ষে ভোট দেয়। এছাড়া ২০২২ সালের মে মাসে সেই দেশের অর্থনীতি ও কর সংক্রান্ত সংসদীয় সাব কমিটি সুইস ব্যাংক নিয়ে থাকা আইন সংশোধনের বিপক্ষে মত দেয়।

সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতিতে সুইস ব্যাংকগুলোর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই দেশের স্থিতিশীল গণতন্ত্র এবং সুইস ব্যাংকের অর্থ অন্য মুদ্রায় রূপান্তর সহজ বিধায় সুইস ব্যাংকগুলো পুরো বিশ্বের নজর কেড়েছে। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ধনী ব্যক্তিদের প্রায়ই তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা রাখতে দেখা যায়।

tanjimhasan001@gmail.com

শেয়ার করুন