প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর চুল পেতে কে না চায়! আজকাল প্রায় সবার কাছে এক অনুযোগ-চুলের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, ঝরে পড়ে যাচ্ছে কিংবা অকালেই তাদের রং বদলে পাক ধরছে। তবে একটা নিয়মমাফিক যত্নে রুক্ষ হয়ে যাওয়া চুলের স্বাস্থ্যোদ্ধার অনেক খানি সম্ভব। আর সেটা নারী-পুরুষ দুজনের জন্যই সমান।
চুলকে ঠিক রাখতে এই যত্নগুলো সাপ্তাহিক বা মাসিকভাবে নেয়া যেতে পারে। ঘরে তৈরি নানা সামগ্রীতেই খুব ভালো ভাবেই চুলের দেখভাল সম্ভব।
চুলের যত্নে কোন ধরণের পণ্য ব্যবহার করতে হবে তা জানতে সবার আগে ধারণা থাকতে হবে হেয়ার পোরোসিটি বা চুলের আদ্রতা গ্রহণ করার ক্ষমতা নিয়ে। নিম্ন পোরোসিটি চুলের কিউটিকল ফ্ল্যাট আর প্যাকড থাকে, যার কারণে চুল আর্দ্রতা শুষে নিতে সময় নেয়।
এই ধরণের চুল তৈরিতে সমস্যা থাকে। এই ধরণের চুলে হালকা তেল ব্যবহার করতে হয়। জলীয় বেসের পণ্য লিভ-অন বা কন্ডিশনার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
মাঝে মাঝে একটু স্টিম বাথ নিলে চুলের কিউটিকলগুলি খুলবে ও আর্দ্রতা ধরে রাখবে। মধ্যম বা সাধারণ মানের পোরোসিটিতে কিউটিকল অনেকখানি আর্দ্রতা শুষে নিতে পারে এবং এই ধরনের চুল আগলানো সোজা এবং যেকোনো ধরনের হেয়ার স্টাইল করা সম্ভব।
সাধারণ মানের সব চুলের যত্নের পণ্য এখানে ব্যবহার করা যাবে। এই চুলে গভীর মাত্রায় কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হয়। উচ্চ পোরোসিটির চুলে কিউটিকলগুলো ঢিলে এবং দূরত্বে থাকে, ফলে আর্দ্রতা সহজেই প্রবেশ করে এবং দ্রুত বেরিয়ে যায় ফলে চুল শুকনো, ভঙ্গুর হতে পারে।
এই চুলে তাই কেরাটিন বা সিল্ক প্রোটিনযুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে হবে। চুলে আর্দ্রতা ধরে রাখতে শিয়া বাটারের মতো ক্রিম ব্যবহার্য। নারকেল তেল, ক্যাস্টর তেলের মতোন ভারী তেল আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য ভালো। হালকা ক্লিনজার ব্যবহার করা উচিত, যা চুলের প্রাকৃতিক তেল না কেড়ে হালকা পরিষ্কার করবে।
পোরোসিটির আন্দাজ যেভাবে পাওয়া যাবে- একটি পাত্রে পানি নিতে হবে। এবার দু একটা চুল রেখে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর যদি চুলটি সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে যায় তবে সেটি উচ্চ পোরোসিটি নির্দেশ করে। যদি পাত্রের মাঝামাঝি থাকে তবে মধ্যম। আর যদি উপরের দিকে ভেসে থাকে তবে নিম্ন পোরোসিটির চুল
তেলে চুল তাজা
তেলকে চুলের খাদ্য বলা হয়, কেননা চুলের যত্নে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখা, পুষ্টি জোগানো, স্ক্যাল্পের রক্ত সঞ্চালন বাড়ানো, চুলের ভঙ্গুরতা কমানো, খুশকি দূর করা এসবই তেলের কাজ।
তেল চুলের গভীরে প্রবেশ করে আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং শুষ্কতা দূর করে। এটি চুলকে নরম ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে। তেলে থাকা ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চুলের শিকড়কে শক্তিশালী করে। বিশেষ করে নারকেল তেল, ক্যাস্টর তেল, বাদাম তেল, আরগান তেল এবং অলিভ অয়েল চুলের পুষ্টি জোগাতে কার্যকর।
তেল ব্যবহার করার সঠিক উপায়
১) তেল হালকা গরম করে মাথার ত্বকে ও চুলে লাগাতে হবে।
২) আঙুলের সাহায্যে আলতো করে পুরো স্ক্যাল্প জুড়ে ম্যাসাজ করতে হবে।
৩) ২-৩ ঘণ্টা রেখে দিন বা সারারাত রাখতে পারেন।
৪) অবশ্যই মৃদুমাত্রার শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। তেল চুলে রেখে দিলে ধুলি-ময়লা আকৃষ্ট হয়ে চুলে লেগে থাকবে।
৫) সপ্তাহে ২-৩ বার তেল লাগানো চুলের জন্য আদর্শ। তবে চুলের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী এটি কম-বেশি হতে পারে।
৬) চুলের ধরন অনুযায়ী তেল বেছে নিতে হবে। রুক্ষ ও শুষ্ক চুলে- বাদাম, জলপাই, আরগন আর নারকেল তেল খুব ভালো ফল আনে। তৈলাক্ত চুলে ঘৃতকুমারী আর জোজোবার তেল। ভঙ্গুর চুলে জোজোবা ভালো কাজ করে। একটু রুক্ষ ও কোঁকড়া চুলে শিয়া বাটার তেল। সাধারণ চুলে নারকেল তেল ব্যবহারই সর্বোত্তম।
৭) শুধু একরকম তেল না ব্যবহার না করে প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েক রকম তেল মিশিয়ে ব্যবহার করলে অন্যরকম ফল চোখে পড়বে। চাইলে তেলের মিশ্রণের সঙ্গে সঙ্গে আমলকি, মেথি, তিল, কালোজিরা, জবাফুল বা অ্যালোভেরা মিশিয়ে তেলে ফুটিয়ে তারপর ঠান্ডা করে সেই তেল সংরক্ষণ করে অনেকদিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। চুলের সবরকম পুষ্টি জোগাতে এই তেলের জুড়ি নেই।
যত্নে শ্যাম্পু আর কন্ডিশনার
চুল পরিষ্কার রাখার জন্য একটি অপরিহার্য পণ্য শ্যাম্পু। এটি চুলের ময়লা, তেল, ধুলাবালি এবং স্ক্যাল্পে জমে থাকা মৃত কোষ দূর করতে সাহায্য করে। তবে সঠিক শ্যাম্পু নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, চুলের স্বাস্থ্য শ্যাম্পুর গুণমান এবং এর উপাদানের ওপর নির্ভর করে। শ্যাম্পু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দেখতে হবে সেটি যেন চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং যেন সালফেট এবং প্যারাবেন মুক্ত থাকে।শ্যাম্পু সপ্তাহে দুইদিন ব্যবহার করতে হবে। তাই সাধারণত তেল বা প্যাক ব্যবহারের পরে শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলা হয়।
চুল ভিজিয়ে শ্যাম্পু হাতে নিতে ভালো করে পুরো স্ক্যাল্প জুড়ে ঘষে নিতে হবে। চুলের আগা অব্দি ফেনা যেন পৌঁছায়। আজকাল চুলের গোড়া অব্দি ভালো করে পরিষ্কার করতে সিলিকনের ব্রাশ পাওয়া যায়। এটি হেয়ার বিল্ড-আপ থেকে মুক্তি দেবে।
শ্যাম্পু ব্যবহারের সময় দুইবার ব্যবহার করতে হবে। প্রথম ধোয়ায় ত্বকের থেকে সেবাম বের হবে। তাই আরেকবার ধুলে সেই সেবামটা ধুয়ে যাবে, চিটচিটে ব্যাপারটা থাকবে না। শ্যাম্পুর পরে অবশ্যই কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে।
প্রাকৃতিক উপায়ে ঘরে ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত শ্যাম্পু প্রস্তুত সম্ভব। এজন্য রিঠা, শিকাকাই, শুকনো আলমকি, মেথি, তিশি, সাথে কয়েকটি নিম পাতা সারারাত পানিতে ভিজিয়ে একটুখানি উনুনে ফুটিয়ে নিতে হবে, অনেকটা ফেনা ফেনা উঠে আসবে। এরপর ঠান্ডা করে নিলেই প্রস্তুতকৃত শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে। তবে এটা ফ্রিজে রেখে ব্যবহার করতে হবে।
হেয়ার টোনার ও সেরাম
হেয়ার সিরাম একটি চুলের যত্নকারক পণ্য যা চুলের উপরের স্তরে কাজ করে। এটি চুলকে মসৃণ, ঝলমলে এবং সহজে পরিচালনাযোগ্য করে তোলে। সিরাম চুলকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং ফ্রিজি, রুক্ষ বা প্রাণহীন চুলে প্রাণ ফিরিয়ে আনে।
যেদিন চুলে শ্যাম্পু করা হবে সেদিন চুল শুকিয়ে কয়েক ফোঁটা সেরাম হাতে ঘষে পুরো চুলে আলতো করে ম্যাসাজ করে লাগাতে হবে। এতে চুলে জট থাকবে না কোনো, আঁচড়ানো সহজ হবে।
টোনারটি ঘরে অতি সহজেই প্রস্তুত সম্ভব। একটি পাত্রে দুই চা চামচ শুকনো রোজমেরির পাতা ও এক চা চামচ লবঙ্গ নিয়ে এক লিটার মতো পানি নিয়ে মৃদু আঁচে ১৫ মিনিটের মতন সেদ্ধ করে পানিটা ঠান্ডা করে, ছেঁকে নিলেই চুলের টোনার প্রস্তুত। এটাকে একটা স্প্রেয়ার বোতলে করে ৫-৭ দিনের মতন ব্যবহার করা যাবে। এটা ব্যবহার করে ধুয়ে ফেলতে হবে না। এটি রোজ একবার ব্যবহারে চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে, মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করবে এবং খুশকি জন্মাতে দিবে না।
হেয়ার প্যাক ও মাস্ক
মাসে দুবার হেয়ার প্যাক ব্যবহার করা উচিত।
কয়েকটি হেয়ার প্যাক তৈরি-
হারবাল প্যাক–শিকাকাই, রিঠা, জবা, মেহেদী, আমলকি গুঁড়ো একত্রে মিশিয়ে প্রস্তুত করতে হবে।
প্রোটিন প্যাক–কলা, টকদই, ডিমের সাদা অংশ।
১৫-৩০ মিনিট রেখে সামান্য কুসুম পানিতে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
হেয়ার মাস্ক একটি গভীর কন্ডিশনিং ট্রিটমেন্ট, যা চুলের পুষ্টি জোগায় ও মেরামত করে। এটি সাধারণ কন্ডিশনারের তুলনায় অনেক বেশি ঘন এবং কার্যকর, তাই এটি বিশেষভাবে শুষ্ক, ক্ষতিগ্রস্ত, বা ফ্রিজি চুলের জন্য উপযুক্ত।
চুল ভিজিয়ে হেয়ার মাস্ক মেখে ৫-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। চুলের গোড়া পর্যন্ত যেন না যায়। একটা শাওয়ার ক্যাপ পরে নিতে হবে। এরপর ধুয়ে ফেলতে হবে। হেয়ার মাস্ক মাসে এক বার ব্যবহারই যথেষ্ট। কেননা এতে এমন রাসায়নিক থাকে, যা বেশি ব্যবহারে হিতে বিপরীত হতে পারে
চুলের বিল্ড-আপ সমস্যার সমাধান
চুলের বিল্ড আপ (পণ্য বা তেলের স্তর জমে যাওয়া) সমস্যার সমাধানে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি। এটি চুল নিষ্প্রাণ, চিটচিটে এবং ভারী করে তুলতে পারে।
এটা থেকে মুক্তি পেতে সালফেট-মুক্ত ক্ল্যারিফাইং শ্যাম্পু ভালো। এছাড়া শ্যাম্পুর পর তিন ভাগ পানির ভেতর একভাগ আপেল সাইডার ভিনেগারের মিশ্রণ দিয়ে চুল ধুয়ে নিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া এক টেবিল চামচ পানিতে সামান্য পানি মিশিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে মাথায় লাগিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেললে সব বিল্ড-আপ চলে যাবে। এরপরে ঘৃতকুমারীর জেল দিয়ে মাথায় ম্যাসাজ করে নিতে হবে। মাসে একবার মাত্র এই উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
খাবারে খেয়াল
শুধু বাইরে থেকে নয়, যত্ন হোক ভেতর থেকেও। এজন্য রোজকার খাবারের তালিকায় যুক্ত করতে হবে প্রোটিন, ভিটামিন, বায়োটিন এবং ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাদ্য।
ডিম, ডাল বা লিগিউমস, সয়াবিন, মুরগির মাংস, টুনা ইত্যাদি চুলের বৃদ্ধির জন্যে দরকারি প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে। ডিমের কুসুম,মিষ্টি আলু,কলা, বাদাম বা বীজ জাতীয় খাবার বায়োটিনের ভালো উৎস। আমলকির ভিটামিন সি আর গাজর ও পালং শাকের ভিটামিন এ চুলের জন্য খুব ভালো। লইট্টা, ভেটকি, পুঁটি, বাগদা চিংড়ি, ইলিশ, কাতলা, রুই, আইড়, চাপিলা ইত্যাদি মাছে আছে ওমেগা ৩।
বদল হোক কিছু অভ্যেস
রোজকার জীবনাচারেও আনতে হবে কিছু পরিবর্তন। দুশ্চিন্তা ও চাপমুক্ত জীবনধারা চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে অনেকটা মুক্তি দেবে। এজন্য ধ্যান বা যোগাভ্যাস করা যেতে পারে।চুল আঁচড়ানোর জন্যে প্লাস্টিকের চিরুনি ত্যাগ করতে হবে, বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে হবে নিম বা চন্দন কাঠের চিরুনী বা বাঁশের কাটার ব্রাশগুলি। লম্বা চুল হলে রাতে বেণী করে ঘুমাতে যেতে হবে। বালিশে সুতি কভার থাকলে সেটি পাল্টে ব্যবহার করতে হবে স্যাটিন বা সিল্কের কভার। সাধারণ দিনে বাইরে বের হলে মাথায় ওড়না জড়িয়ে বের হতে হবে, যাতে করে চুল ধুলো বালি আর সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা পায়। এছাড়া খুব তাপে বা সমুদ্রসৈকতে গেলে ব্যবহার করা যেতে পারে চুলের জন্য তৈরি সানস্ক্রিন মিস্টগুলি।
তাপ প্রয়োগকারী যন্ত্র যেমন হেয়ার ড্রাইয়ার বা স্ট্রেইটনার গুলি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে, কেননা এগুলি চুলের ভঙ্গুরতার জন্যে দায়ী। একান্তই ব্যবহার করলে চুলে আগে হিট প্রটেক্টর সল্যুশন বা সেরাম মেখে নিতে হবে।
roysushmitadiba@gmail.com