অনুস্কা ব্যানার্জী (শ্রাবস্তী)
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
‘তোমার হাতের স্পর্শ, কপালের টিপ,
তোমার কন্ঠের মৃদু গুনগুন ধ্বনি,হাসি,কালো
চুল আর অতল চোখের দু'টি শিখা দিতে পারে যত আলো
তত আর দেয়নাকো অন্য কোনো জ্ঞানের প্রদীপ’
-শামসুর রাহমান
বঙ্গবালার শাশ্বত রূপ চিত্রায়নে সাহিত্যে-শিল্পকলায় নারীর কপালে দেয়া হয়েছে টিপ। বাঙালি নারী পরিপূর্ণ সাজসজ্জা থেকে সন্তানকে কুনজরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে শরণাপন্ন হয়েছে টিপের। টিপ আমাদের লোক-লৌকিকতা থেকে অঙ্গরাগের উপাদান হিসেবে নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
টিপ শব্দটি হচ্ছে বিশেষ্য পদ যার অর্থ ললাটের ফোঁটা বা সেইরূপ অলংকারবিশেষ। ধারণা করা হয়, টিপ শব্দটি এসেছে ‘টিকা’ থেকে। প্রাচীন নাম তিলকা এবং টিকা বা টিক্কা এর বিকৃত রূপ। টিপের রয়েছে নানা রকমফের। এর মধ্যে রয়েছে বিন্দি যেটি এসেছে ‘বিন্দু’ থেকে।
টিপের ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের টিপের ইতিহাস বেশ পুরানো।টিপ এই উপমহাদেশের বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ -থাইল্যান্ড, মৌরিতানিয়ায়ও প্রচলিত। ঋগবেদে টিপের উল্লেখ আছে, যা থেকে বোঝা যায় যে টিপের ইতিহাস শুধু প্রাচীন নয়, সুপ্রাচীন- এবং এর প্রচলন প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে!
কেমন করে টিপ এলো
টিপের ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও মানুষ ঠিক কবে থেকে টিপ পরা শুরু করে - এ বলা বেশ মুশকিল! প্রাচীনকালে শৌখিন নারীরা সাজসজ্জার সরঞ্জাম হিসেবে লাক্ষারস দিয়ে ঠোঁট রাঙানোর পাশাপাশি কপাল রাঙানোও শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের ফুল, পাতা, হলুদ ইত্যাদি প্রসাধনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহারের ঝোঁক দেখা দেয়। পরবর্তীতে প্রদীপের শীষ কিংবা চুলার কালি দিয়ে কপালে ফোঁটা দেয়ার প্রচলন শুরু হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে টিপের আবির্ভাব।
বর্ণপ্রথা ও টিপ
ইতিহাসের অলিগলি বইয়ে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে পুরো একটি অধ্যায় লিখেছেন। একসময় টিপের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে নারী-পুরুষ টিপের ব্যবহার করতেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার উচ্চশ্রেণি তথা ব্রাহ্মণরা পবিত্রতার প্রতীক হিসবে কপালে সাদা তিলক দিতেন। অন্যদিকে ক্ষত্রিয়রা ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক ব্যবহার করতেন লাল টিপ। বৈশ্যরা ব্যবহার করতো হলুদ টিপ এবং তথাকথিত অস্পৃশ্য শূদ্র শ্রেণিকে চিহ্নিত করা হতো কালো টিপের দ্বারা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, ''আঠারো বা উনিশ শতকের আগে অনেক সময় টিপ নারীদের শ্রেণি, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হতো।"
ভাস্কর্যে টিপ
টিপ বাংলার ভাস্কর্যের একখানা অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা চলে। আমাদের শিল্পের আদিমতম নিদর্শন অজন্তা বা ইলোরার শৈল্পিক অবয়বে টিপের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে প্রাপ্ত ১ শতকের একটি ভাস্কর্যের কপালে, রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত ১১ শতকের একটি মূর্তির কপালে, ৯-১০ শতকে প্রাপ্ত একটি গরুড় মূর্তির কপালে, বগুড়ার আদমদিঘিতে প্রাপ্ত ১০-১১ শতকের একটি ভাস্কর্যসহ বহু মূর্তি-ভাস্কর্যে টিপের উপস্থিতি মেলে। সোনা বা রূপায় তৈরি এক ধরণের টিপ বেশ কিছু ভাস্কর্যে দেখা যায়, যেগুলোকে সিতারা বলা হতো। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে টিপের অবস্থান বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
সাহিত্য আর গানে টিপ
যে নামেই ডাকা হোক না কেন আর মেয়েরা যে অর্থে বা অনর্থেই পরুন না কেন, বিন্দি নামক বস্তুটি এক বিশেষ সমাদর পেয়েছে শিল্প-সাহিত্যে। আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা কিংবা কবি কাজী নজরুল ইসলামের রোজ তাই চাঁদা ভাই টিপ দেয় কপালে এসমস্ত ছড়া মনে করিয়ে দেয় একটুকরো ছেলেবেলা। সাহিত্যের বিভিন্ন লেখায় টিপের উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায়৷ ‘কপালের একটি ছোট উল্কী টিপের মত দেখাইত’; রবি ঠাকুর লিখেছেন, ‘পরিতেছিলাম কপালে সোনার টিপ’, কবি নজরুলের ভাষায়, ‘জাগো সূর্যের টীপ পরি জয়ন্তিকা’।
বাসন্তী রং শাড়ি প’রো খয়ের রঙের টিপ/ সাঁঝের বেলায় সাজবে যখন জ্বাল্বে যখন দীপ নজরুলের এই বিখ্যাত গান কে না শুনেছে? ষাটের দশকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ, পরেছ শঙ্খদ্বীপের শাঁখা’, মুহম্মদ আজিজের ‘লাল শাড়ী লাল টিপ শ্রীমতি যে যায়’ অ্যাশেজের ‘সে আমারে আমার হতে দেয় না, কার কপালের টিপ, কার কপালের টিপ কার হয়ে যায়’, ‘বিন্দিয়া চমকেগি, চুরি খনকেগি’, ‘তেরি বিন্দিয়া, মেরি নিন্দিয়া’, ‘বিন্দিয়া বোলে, কাজরা বোলে’ ‘আর অভিমানের সেই গান ‘তেরি বিন্দিয়া রে’ ; টিপ নিয়ে দারুণ সব গানেরও জন্ম হয়েছে যুগে যুগে।
টিপের একাল সেকাল
ষাট-সত্তর দশকের সাদাকালো সিনেমায় স্লিভলেস ব্লাউজ, বড় খোঁপা কিংবা বিনুনির সাথে কপালের বেশ ওপরে মাঝারি বা ছোটো সাইজের গোল টিপ পরার ধরন লক্ষ্য করা যায়। চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন, শর্মিলা ঠাকুর, ওয়াহিদা রেহমানের সাজসজ্জায় ধরা পড়বে টিপের তৎকালীন উদীয়মান সেই ধারা।
নব্বইয়ের দশকে এসে চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সাজে দেখা গেল পাতা আকৃতির লম্বাটে টিপ। পরবর্তীতে চন্দ্রাকৃতির টিপ, পুঁতি বসানো টিপ, ডিম্বাকৃতির টিপসহ নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট দেখা যায়। ইদানীংকালে কাঠের টিপ এবং হ্যান্ডপেইন্ট টিপ নারীদের সাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তুলনামূলক আকারে বড়ো বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হ্যান্ডপেইন্ট ও কাঠের টিপের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে।
সাজসজ্জায় নানারঙের টিপ বেঁচে থাকুক হাজার বছর। নারী কিংবা পুরুষের একলার হয়ে নয়, বরং টিপ টিকে থাকুক সর্বজনীনতায় এবং স্বাতন্ত্র্যে।
অনুস্কা ব্যানার্জী (শ্রাবস্তী) বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
banushka0322@gmail.com