প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
ভারতের আসাম রাজ্যের ডিমা হ্যাসাও জেলার পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত গ্রাম জাতিঙ্গা। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শোভিত গ্রামটিতে প্রায় ২,৫০০ আদিবাসী মানুষের বসবাস। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এ গ্রামটিতেই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা, যার সঠিক ব্যাখা কেউ দিতে পারে নি।
এখানে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিরা এসে আত্নহত্যা করে। আনুমানিক ১৯০৫ সাল থেকে ঘটে আসছে ঘটনাটি। একারণে গ্রামটিকে অভিহিত করা হয় ’ডেড ভ্যালি অব বার্ড‘ হিসেবে।
বর্ষা মৌসুমের মধ্য বা শেষেরদিকে অর্থাৎ, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে পাখিদের এই আত্নহননের ঘটনা ঘটে। তবে এই ঘটনা পুরো গ্রামজুড়ে ঘটে না। ঘটে উপত্যকার দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২০০ মিটার প্রস্থের সুনির্দিষ্ট একটি এলাকায়।
আত্নহত্যার চিন্তা মাথায় আসে শুধু মানুষের, অন্তত এটাই জানা ছিল এতদিন। কিন্তু পাখির মতো প্রাণীর ভাবনায় যে আত্নহননের চিন্তা আসে, তার কারণ এখনো অজানা।
স্থানীয়দের মতে, এক অদৃশ্য প্রেতাত্নার কারণে এই ঘটনাটি ঘটে। এসময় তারা আকাশে ঘুরে বেড়ায় এবং যেসব পাখিরা এর বিরোধিতা করে তাদেরকে এরা মাটিতে ছুঁড়ে মারে। তারা প্রথম ঘটনার সাক্ষী হন ১৯০৫ সালে এক ঝড়ের রাতে। সেদিন ঝড়ে গ্রামের একটি মেষ হারিয়ে যায়। মেষটি গ্রামবাসীর কাছে বিশেষ গুরুত্বাবহ হওয়ায় তারা রাতের অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে সেটি খুঁজতে বের হন।
কিন্তু হঠাৎ তারা একটি বিস্ময়কর ঘটনা দেখেন। আকাশ থেকে হাজার হাজার পাখি পাখা ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে তাদের জ্বলন্ত মশালের দিকে ছুটে আসে। মুহূর্তেই পাখিগুলো আগুনে পুড়ে মারা যায়। তখন থেকেই তাদের বিশ্বাস অলৌকিক প্রেতাত্মাই এর জন্য দায়ী।
কিন্তু গ্রামবাসীর এই মতের সাথে একমত নন বিজ্ঞানীরা। সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ প্রাণীবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড রিচার্ড জি এই ঘটনার তথ্য –উপাত্ত সংগ্রহ করেন। তিনিই এই ঘটনাটি বিশ্বের প্রাণী বিজ্ঞানীদের সামনে নিয়ে আসেন।
সেসময় ভারতের বিখ্যাত প্রাণী বিজ্ঞানী সলিম আলিও এটি নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের উভয়ের মতেই, প্রচণ্ড বাতাসের কারণে পাখিরা বেসামাল হয়ে পাহাড়ের কোলে আঁছড়ে পড়ে মারা যায়। কিন্তু তাদের এই যুক্তির তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কেননা, পাখিরা গ্রামের একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় সুনির্দিষ্ট সময়েই মৃত্যবরণ করে এবং সেসময় জাতিঙ্গা গ্রামের অন্যান্য জায়গার ন্যায় সেখানেও একই আবহাওয়া বিরাজ করে।
এরপর ২০০০ সালে ভারতের পাখি বিজ্ঞানী আনোয়ার উদ্দীন চৌধুরী তার ‘দ্যা বার্ডস অফ আসাম’ গ্রন্থে এ ঘটনার ব্যাখা দেন। তার মতে বর্ষাকালে জাতিঙ্গা গ্রামের আকাশের চুম্বকীয় স্তরের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। একারণেই আকাশে উড়তে থাকা পাখিদের পৃথিবী তাদের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। ফলে পাখিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং পাহাড়ে পড়ে মৃত্যবরণ করে।
তার এই গবেষণার পর একদল প্রাণী বিজ্ঞানীকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল এবং তাদের প্রচেষ্টায় সেখানে পাখি মৃত্যুর সংখ্যাও কমেছে বলে তাদের দাবি। তারা গ্রামের বাড়ি গিয়ে বাসিন্দাদের বুঝিয়েছিলেন পাখি মৃত্যর ঘটনা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়। এটি বৈজ্ঞানিক ঘটনা এবং এটি কমাতে তারা গ্রামবাসীর সহায়তা প্রত্যাশা করেন।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক বা অলৌকিক যে কারণেই হোক না কেন প্রতিবছরই জাতিঙ্গা গ্রামে প্রায় ৪৪ প্রজাতির হাজার হাজার পাখির মৃত্যু হয়। আপাতত কোনো দৃশ্যমান কারণ প্রমাণিত না হওয়ায় এই মৃত্যুগুলোকে আত্মহত্যাই মনে করা হচ্ছে।
Aurnobprashad456@gmail.com