Bangla
2 days ago

ভাষা শিক্ষা নিয়ে বিএনপি’র আইডিয়া কতটা বাস্তবসম্মত?

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

অতি সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে ভাষা শিক্ষা নিয়ে একটি আইডিয়া দেয়া হয়েছে। বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ভাষা শিক্ষা নিয়ে এই আইডিয়াটি বলেছেন একটি ভার্চুয়াল সমাবেশে। তিনি বলেছেন,“শিক্ষার্থী বড় হয়ে দেশেই থাকুক আর বিদেশেই থাকুক, আমাদের যেটা পরিকল্পনা আছে যে, আমরা প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি উভয় জায়গাতেই ভাষার ওপরে প্রথমে জোর দিব। যেমন হতে পারে চাইনিজ বা মেন্ডারিন, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, আরবিসহ ছয় সাতটা ভাষা থাকবে। শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রথমে প্রাইমারিতে প্রথম দুই তিন বছরে জার্মান শিখল, যখন ওটার কোর্স তার কমপ্লিট হবে, তারপর সেকেন্ডারিতে গিয়ে সে হয়তো আরেকটা ভাষার উপরে দক্ষতা বাড়ালো। একটা বাচ্চা যদি বড় হতে হতে বাংলাসহ বাইরের তিনটা, নূন্যতম চারটা ভাষার উপরে যদি তার দখল থাকে, আমরা বিশ্বাস করি যে, সে পৃথিবীর যেখানেই যাবে, মোটামুটি একটা কিছু করে নিতে পারবে। কারণ ভাষাটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ, যদি সে বিদেশে যায়।”

এখন দেখা যাক, তারেক রহমান যে প্রস্তাবটি করেছেন, তা আসলেই যৌক্তিক কিনা। অর্থাৎ বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের সত্যিই নতুন ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে কিনা।

যাঁরা বর্তমানে প্রবাসে আছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, একজন ব্যক্তি যত বেশি ভাষা জানবেন, বিশ্ববাজারে তিনি তাঁর কমপিটিটেভনেস (প্রতিযোগিতাসক্ষমতা) ততোই বাড়িয়ে তুলবেন। পৃথিবীতে এমন অনেক চাকরি রয়েছে, যার মূল চাহিদা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষা জানা।

বিদেশের নামকরা কোম্পানিগুলিতে দ্রুত উপরে ওঠার জন্য ইংরেজির পাশাপাশি তৃতীয় এমনকি চতুর্থ ভাষা জানাকেও মূল্য দেয়া হয়। কারণ এই সকল কোম্পানিগুলিকে সারা বিশ্বে ব্যবসা করতে হয়, এবং তাদের স্টাফরা যদি সেই সকল দেশের ভাষা আগেভাগেই জেনে নেয়, তাহলে প্রতিযোগিতায় তারা অনেক এগিয়ে থাকবে।

এই বিষয়ে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। চীনারা আগে ইংরেজিও বলতে পারত না। কিন্তু বিগত ৩০ বছরে তারা এখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছে। তাদের বৃহত কোম্পানিগুলির শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন ইংরেজি তো জানেনই, তাঁরা আরবি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায়ও অনেক দক্ষ।

২০২৪ সালে প্রকাশিত দ্য ওয়াল্ড হিউম্যানিটিজ রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে চীনে প্রায় ৩০ কোটি লোক বিভিন্ন ভাষা শিখছে। বর্তমানে চীনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিদেশি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বিদেশি ভাষা শিক্ষার বিষয়ে চীনে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি রুশ, জাপানি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে চীন সরকার।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভাষা শিক্ষা নিয়ে বিএনপি যে আইডিয়াটি প্রস্তাব করেছে, তা একটি ভিশনারি সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন হলো, এই আইডিয়াটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবায়নযোগ্য।

বিএনপি-র প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা এবং ইংরেজির বাইরে তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পরযায়ে। আমরা নিচের সারণিতে দেখাচ্ছি সারা দেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাঃ

বিভাগ

প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা

ঢাকা

২৩,২৫৩

বরিশাল

৮,৬৬০

চট্টগ্রাম

১৯,৭০১

খুলনা

১২,৫৪৩

ময়মনসিংহ

১০,৪৭১

রাজশাহী

১৪,৮১৮

রংপুর

১৬,৯৪৮

সিলেট

৮,২৩৬

মোট

১১৪,৬৩০

সূত্রঃ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ২০২৩

 

উপরের সারণিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১,১৪,৬৩০। এই স্কুলগুলি রয়েছে সারা দেশ জুড়ে- পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।

এখন সারা দেশের প্রাইমারি স্কুলে যদি তৃতীয় ভাষা হিসাবে জার্মান ভাষা শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে অন্তত ১১৪,৬৩০ জনকে যারা জার্মান ভাষায় দক্ষ। এই পরিমাণ শিক্ষককে জার্মান ভাষায় প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের সর্বত্র পাঠাতে হবে শিক্ষা দেয়ার জন্য।

এটি যেহেতু প্রাথমিক স্তরে বাস্তবায়ন করা হবে, তাই সারা দেশে একযোগে এই আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে করলে তা বিভিন্ন জেলার মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। আর এভাবে করা হলে শুরুতেই এই আইডিয়া নিয়ে সবাই বিরোধিতা শুরু করবে।

এখন প্রশ্ন হল, যে ব্যক্তি জার্মান ভাষা শিখবে এবং বলতে পারবে, সে কি গ্রামে গিয়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে রাজি হবে? আমরা কি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদেরকে সেই পরিমাণ বেতন-ভাতা দিচ্ছি যাতে একজন মেধাবী যুবক বা নারী গ্রামে গিয়ে প্রাথমিক স্তরে লেভেলে শিক্ষকতা করবেন?

জার্মান ভাষা জানা একজন যোগ্য শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে বর্তমান বাস্তবতায় গ্রামে গিয়ে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতা করার সম্ভাবনা অনেক কম। এই ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে অধিকাংশ শিক্ষক হয় বিদেশে চলে যাবেন, না হয় তারা আরো ভাল বেতনের অন্য কোনো চাকুরিতে যোগ দেবেন। বাংলাদেশে এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি লোভনীয় কোন চাকরি নয়। ফলে এই আইডিয়া বাস্তবায়নে শুরুতেই এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে।

তাই জার্মান ভাষা জানা একজন শিক্ষককে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রথমে প্রাথমিক স্তরে ভাল বেতন-ভাতা দিতে হবে এবং গ্রামে নগরায়নের সুবিধা বাড়াতে হবে। কিন্তু বেতন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজস্ব বাড়ানো, বর্তমানে যা অনেক কম।  এই প্রতিবন্ধকতা দূর করে এই আইডিয়াকে বাস্তবায়ন করার জন্য একাধিক ভাষা শিক্ষাদানের গোটা চিন্তাটাকে প্রথমেই তিনটি ধাপে ভেঙে ফেলতে হবে। প্রথম ধাপের সময়কাল হবে পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে সারা দেশে প্রতি বছর অন্তত ৫০০০ শিক্ষক তৈরি করতে হবে যারা তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাষা জানেন। এই কর্মসূচিতে সাহায্য নিতে হবে বিদেশি সরকারগুলোর যারা এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হবে।

এখন, এই পাঁচ বছরে আমরা শিক্ষক পাব ২৫,০০০। এরা যখন প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে আসা শুরু করবেন, তখন তাদেরকে নিয়োগ দিতে হবে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটগুলিতে যেখানে তাঁরা আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন। এরপর যখন দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে তৃতীয় এবং চতুর্থ ভাষার শিক্ষক তৈরি হয়ে যাবে, তখন এই প্রশিক্ষণ কলেজ পর্যায়ে শুরু করতে হবে। এরপরের ধাপে মাধ্যমিক এবং সর্বশেষে প্রাথমিক স্তরে এই কর্মসূচি শুরু করতে হবে।

তাই প্রাথমিক স্তরে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে অন্তত ১০-১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ে দেশের রাজস্ব বাড়াতে হবে এবং দেশের গ্রামগুলিকে নগর পরিকল্পনাতে নিয়ে আসতে হবে। ফলে একজন শহুরে শিক্ষক গ্রামে গিয়ে পড়াতে আগ্রহী হবেন। শুধু তাহলেই এই আইডিয়ার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

এই আইডিয়াটি যেহেতু বিএনপি-র শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেহেতু এটা ধরে নেয়া যায় যে আগামী নির্বাচনে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রæতিতে এই আইডিয়াটি যোগ করা হবে। তবে এই আইডিয়াকে বাস্তবায়ন উপযোগী করার জন্য একে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোন স্তরে বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এতে বিএনপি-র পক্ষ থেকে পরবর্তীতে দেশের আর্থ-সামাজিক অপ্রিয় বাস্তবতায় জনগণকে দেয়া ওয়াদা সময়মত রক্ষা করার সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, আইডিয়াজ ফর ডেভলপমেন্ট (আইএফডি); ইমেইলঃ ideasfd@gmail.com

শেয়ার করুন