প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
বাঙালিদের কাছে বৃষ্টির দিনের সঙ্গে খিচুড়ির সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ। আগেকার দিনে বৃষ্টির সময়ে রান্না সহজে করার তাগিদ থেকে চাল-ডাল একসাথে মিশিয়ে রান্না করা হতো খিচুড়ি। তবে সেই খিচুড়ি এখন আর নিছক প্রয়োজন হয়ে নেই, বৃষ্টি উপভোগের অন্যতম মাধ্যম বা সঙ্গী হয়ে রয়েছে।
সাধারণত বৃষ্টির দিনে বাসা-বাড়িতে খিচুড়ি রান্না হয়েই থাকে। তবে কখনো-সখনো খিচুটি খেতে বাইরেও যেতে চায় মন। তেমন হলে স্বাদ নেয়া যেতে পারে পুরান ঢাকার সাত রওজা এলাকার শামসের আলীর ভুনা খিচুড়ির।
দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ে সাইনবোর্ডের লেখা - 'বৃষ্টিভেজা দিন, ভুনা খিচুড়ির মজা নিন।' দোকানটি ছোট। কক্ষের দেয়ালে টিয়ে রং। তিনটি টেবিল, সেখানে বসতে পারবেন ১২ জন। আশপাশে আছে স্বনামখ্যাত কিছু বিরিয়ানির দোকান। তবে খিচুড়ির দোকান এইটিই।
পাওয়া যায় চার ধরনের খিচুড়ি; স্পেশাল লেগ খিচুড়ি তার ভেতর সবচেয়ে বিখ্যাত। এক প্লেটের মূল্য ৪১০ টাকা! দাম শুনে অনেকের কাছেই মনে হতে পারে বেশি। তবে একটু আলাদা ধরনের স্বাদ চাইলে পরখ করে দেখা যেতেই পারে।
ভুনা খিচুড়ি, কিন্তু তেলের বাড়াবাড়ি নেই। ঝাল-মসলা খুব পরিমিত। সঙ্গে খাসির সুসিদ্ধ, মোলায়েম মাংস। এর সাথে আছে তাদের জলপাইয়ের আচার, সালাদ ও 'এক্সট্রা' ঝোল।
সাধারণত দোকানে যে ধরনের খিচুড়ি খাওয়া হয়ে থাকে, এর স্বাদ সে তুলনায় একটু ভিন্ন। মাংসের টুকরো খুবই নরম, ঝাল কম।
দোকানের ক্যাশে বসেন মো.আছির। তিনি জানান, "আমার আগে নিজের দোকান ছিলো, চিকেন তেহারির। পরে বয়সের কারণে আর চালাতে পারতাম না। তারপর এই দোকানে ঢুকলাম।"
তার কাছ থেকে জানা গেল দোকানের এই খিচুড়ির ভিন্ন স্বাদের রহস্য। রহস্যটা আসলে ডাল ও মসলায়।
তিনি বললেন, "দোকানটার শুরু ২০০৪ সালে। শামসের আলী একসময় সৌদি আরবে ছিলেন। সেখান থেকে দুবাই, ইন্ডিয়া হয়ে এখানে, মানে আবার বাংলাদেশে। তার ইন্ডিয়ান এক বন্ধুর থেকে এই রেসিপি প্রথম পান। তারপর দেশে ফিরে সেই রেসিপি অনুযায়ী রান্না করতে থাকেন। অল্পদিনেই নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই রেসিপিটি জানাজানি হোক তা তিনি চান না। তাই এর কোনো শাখা করেননি।"
শামসের আলী ১৯৯৭ সালে রোজগারার্থে যান সৌদি আরবে। তার সেই ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় সেখান থেকেই৷ রান্নার ধরনটি মূলত দিল্লীতে প্রচলিত একটি রেসিপি থেকে নেয়া। বন্ধুর রান্না করা সেই খিচুড়ি খেয়ে মুগ্ধ হন শামসের আলী। তার অনুরোধে সেই ভারতীয় পাচক তাকে শিখিয়ে দেন খিচুড়ি রান্নার পদ্ধতি।
২০০৩/০৪ সালের দিকে দেশে ফেরেন শামসের আলী। তারপর ক্রেতাদের ভিন্ন স্বাদ দিতে শুরু করেন এই খিচুড়ি রান্না। প্রথমদিন মাত্র ২ কেজি চাল দিয়ে অল্প খিচুড়ি রাঁধেন। সেটি শেষ হয়ে যায় অল্প সময়েই। এরপর ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে যায় তার দোকানের নাম।
'লাভ শেপ'-এ পরিবেশিত খাসির লেগ রোস্ট খিচুড়ি
আছির জানান, " শামসের আলী নিজেই সব রান্না করেন। উনি পুরান ঢাকার বংশালের ছেলে। এই রান্নার জন্য সাধারণভাবে যেসব মসলা লাগে, সেসব তো ব্যবহার করা হয়ই, এর বাইরে ইন্ডিয়া থেকেও উনি মসলা আনান।”
“প্রতিদিন কসাইটুলি থেকে টাটকা খাসির মাংস আনা হয়। রানের দিকের আর সিনার দিকের। পাঁজর, গর্দানের মাংস নেয়া হয়না। কন্ট্রাক্ট আছে এক দোকানের সঙ্গে। তারা চাহিদামতো পিস করে দেয়। কেজিতে ১২০০ টাকার মতো দাম পড়ে। দৈনিক ৩০-৪০ কেজি মাংস লাগে।”
আছির আরো জানান, “একটা রানের মাংস থেকে তিন ধরনের পিস হয়। স্পেশাল লেগ, রানের চাকা মাংস আর পেছনের মাংস। সিনার দিক থেকে হয় চাপের মাংস। এই মোট চার ধরনের মাংসের আইটেম। এর সঙ্গে দেওয়া হয় মুগ আর মাসকালাইয়ের ডাল।”
মুগ ডাল আমাদের দেশেরগুলো হয় একটু বড়। তাই শামসের আলী ইন্ডিয়ান মুগ ডাল ব্যবহার করেন। এর সঙ্গে দেশি মাসকালাই। চাল ডালের অনুপাত প্রায় সমান। আর জিরা, গোলমরিচ, গরম মসলা - এগুলো তো আছেই, আলাদা কিছু মসলা ভারত থেকে আনান, সেটা সিক্রেট!
দোকানে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার ছবি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন বলে জানা গেলো। বঙ্গভবনের এক অনুষ্ঠানের জন্য রেঁধেছিলেন গরুর মাংসের কয়েকটি পদ। নুনিয়া শাক দিয়ে গরুর মাংস, আনারস, আমড়া দিয়েও গরুর মাংসের পদ। এর সঙ্গে তার ট্রেডমার্ক সেই খিচুড়ি। পরে জেলা প্রশাসক থেকে শুনেছিলেন, রাষ্ট্রপতি তার রান্নার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন!
ব্যাপক সাফল্য ও জনপ্রিয়তার পরও অন্য কোথাও শাখা খোলেননি শামসের আলী। এ ব্যাপারে মো. আছির জানালেন, "উনি এখনো নিজ হাতে পুরো খাবার রান্না করেন। অন্য কাউকে রেসিপি জানাননি। আর এটা জানাজানি হোক তা তিনি চাননি, তাই কোনো শাখা খোলেননি।"
শামসের আলীর এই খিচুড়ির স্বাদ অপরাপর খিচুড়িগুলো থেকে ভিন্ন। এর পেছনে মূলত ভূমিকা রেখেছে ভারতীয় সেই মসলাগুলো আর মুগ ডাল। তবে কারো কাছে এই খিচুড়ি যেমন লা-জবাব, আবার কারো কাছে ব্যতিক্রমি এই স্বাদ তেমন মনকাড়া নয়।
যেহেতু অন্য কেউই রেসিপি জানেনা, সেক্ষেত্রে এই খিচুড়ি কি একসময় হারিয়ে যাবে- এমন প্রশ্নে হেসে মো.আছির বললেন, "শামসের আলীর ছেলে আছে। এ এখনো ছোট। বড় হলে ওকে হয়তো রেসিপি শিখিয়ে দেবেন। তবে শামসের আলী চান অন্য সব দোকান থেকে আলাদা স্বাদ নিয়ে টিকে থাকুক এই খিচুড়ি, তাই মসলা বা রান্নার প্রক্রিয়া নিয়ে এই গোপনীয়তা বজায় রাখেন।"
প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে রাত ৮ টা / সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই দোকানটি। আছির বলেন, "বৃষ্টির দিনে কখনো কখনো সন্ধ্যা ৬ টার ভিতরই খাবার শেষ হয়ে যায়। আপনি ৪ টার দিকে যে খেলেন, এটা রাতের শিফটের খাবার। আজকে বিক্রি-বাট্টা বেশি, তাই পরের শিফটের খাবার আগেই চলে আসছে, হয়তো সন্ধ্যার ভিতরেই শেষ হয়ে যাবে।"
mahmudnewaz939@gmail.com