Bangla
7 months ago

ভিন্নধর্মী এক ইউটিউব চ্যানেল: খেলার ছলে খাবার জেতার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

নারী-পুরুষ কিংবা বৃদ্ধ-শিশুসহ লিঙ্গ, ধর্ম, মত, বয়স নির্বিশেষে গ্রামের সকল মানুষ জড়ো হয়েছেন এক জায়গায়। বিভিন্ন মজাদার খেলা চলছে আর তাই দেখছে সবাই অধীর আগ্রহের সাথে। খেলছে অল্প কয়েকজন কিন্তু বাকি সবার মধ্যে উত্তেজনাও কম না। 

এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই হয়তো দেখেছেন। বিভিন্ন মজাদার খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জিতে নেওয়া যাচ্ছে, আর এ আয়োজনেই গ্রামবাসীর উৎসাহের কোনো কমতি নেই। এ আকর্ষণীয় এবং ভিন্নধর্মী আয়োজন প্রায় তিন বছর ধরে করে চলেছে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ। 

চোখ বেধে গোল দেওয়া, ফুটবল কিক করে ড্রামের ভেতর দিয়ে গোল দেওয়া, টিউবে কিংবা তৈলাক্ত কলাগাছে হেঁটে নদী পার হওয়া এরকম ভিন্নধর্মী এবং নতুন খেলার আয়োজন করে থাকেন তারা। আর এসব চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করে যারা জিতে চায় তাদেরকে দেওয়া হয় চাল, ডাল, আটা কিংবা তেলের মতো বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। 

এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের উদ্যোক্তা মোঃ ওমর সানি সম্রাট পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার বনয়ারীনগর গ্রামের মানুষ। নিজ গ্রাম থেকেই স্কুলজীবন শেষ করে তিনি ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে এবং সেখানে চেম্বার সচিব হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মূলত সেসময় থেকেই তিনি ইউটিউবে ভিডিও বানানো শুরু করলেন। শুরুর দিকে বিভিন্ন মজার ভিডিও তৈরির চ্যানেল এবং গানের চ্যানেল দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। 

এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের যাত্রা শুরু মূলত ২০২১ সালের মার্চ মাসের দিকে। তবে এখনকার মতো খেলার আয়োজন তখন ছিল না। একদম অন্যরকম ছিলো শুরুর দিকের গল্পটা। ৩টি আস্ত মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার প্রতিযোগিতা, ৩০টি ডিম খাওয়ার প্রতিযোগিতা, ১ মিনিটে ১ কেজি ছানা খাওয়ার প্রতিযোগিতা এরকম মজার মজার চ্যালেঞ্জ দিয়ে প্রথমদিকে শুরু করা হয়। 

ওমর সানি সম্রাট বলেন, “আমরা প্রথমদিকে ফুড চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুরু করি আমাদের চ্যানেল। অর্থাৎ, যেকোনো একটি খাবার কে কতো দ্রুত খেতে পারে তার ওপর ভিত্তি করে চ্যালেঞ্জটি ছিল। ৪-৫টি ভিডিও বানানোর পরই আমরা প্রচুর সাড়া পেতে থাকি এবং আমাদের ভিডিওর রিচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এ চ্যালেঞ্জটি কারণ খাবারে ভিন্নতা আনা কঠিন ছিলো। এছাড়াও খাবার খেয়ে কেউ কোনো কারণে অসুস্থ হলে সেটাও আমাদের জন্য একটি বড় সমস্যা ছিলো।“

নতুনত্ব আনার চিন্তা থেকেই মূলত তার আরেকটি চ্যানেল ‘উই এক্সপ্লোর’ থেকে প্রথমবারের মতো খেলার মাধ্যমে পুরস্কার জেতার চ্যালেঞ্জ শুরু করলেন। প্রথমে শুধুমাত্র ছোটোদের জন্য এ চ্যালেঞ্জের শুরু হয় এবং এতে ব্যাপক সাড়া পান সম্রাট। ছোটোদের এ খেলা দেখে বয়সে বড়রাও আগ্রহ দেখাতে শুরু করলো। ফলে বড়দের নিয়েও এ খেলা শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবার জন্যই এরকম আয়োজন শুরু হয়। 

“শুরুর দিকের খেলাগুলো প্রচলিত সাধারণ কিছু খেলাই ছিলো। আগস্ট মাসের দিকে আমরা এভাবে খেলাগুলো চালিয়ে বিজয়ীদের জন্য জগ, থালা-বাসন এরকম পুরস্কার রাখতাম। এরপর আমাদের মাথায় আসলো যে করোনা প্রকোপের কারণে অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আর সেখান থেকেই আমরা বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী পুরস্কার দেওয়া শুরু করলাম,” বলেন ওমর সানি সম্রাট। 

মূল্যবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন জিনিস মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও ওমর সানি এবং তার টিমের উদ্দেশ্য ছিলো। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, যখন সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে শুরু করে তখন তারা পুরস্কার হিসেবে সয়াবিন তেল দিয়েছিলেন। 

ধীরে ধীরে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের খেলার ধরণে আসতে শুরু করে পরিবর্তন। বিভিন্ন নতুন নতুন মজার খেলা তৈরি করতে থাকেন ওমর সানির টিমের সদস্যরা। আস্তে আস্তে সেসব ভিডিওর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে এবং চ্যানেলের নিয়মিত দর্শক বাড়তে থাকে। 

২০২১ সালের শেষের দিকে ওমর সানি বুঝতে পারেন যে তার চ্যানেল এখন শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে এবং এখানে আরো বেশি সময় দেওয়া দরকার। তাই তিনি তার চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং পুরোদমে ইউটিউবিংয়ের দিকে মনোযোগী হন। 

ওমর সানি সম্রাটের থেকে জানা যায়, প্রতি মাসে তারা প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা সমমূল্যের পুরস্কার বিতরণ করে থাকেন খেলাগুলোর মাধ্যমে। আর এ খরচের সম্পূর্ণটাই আসে ইউটিউব এবং ফেসবুক থেকে যে টাকা উপার্জন হয় সেটার মাধ্যমে। বাইরে থেকে কোনো স্পন্সর কিংবা সহযোগিতা ছাড়া নিজেরাই সম্পূর্ণ খরচ বহন করেন তারা। 

বর্তমানে মোঃ ওমর সানি সম্রাটের টিমের সদস্য সংখ্যা ২০ জনের বেশি যারা একেকজন একেক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। খেলাগুলো উপস্থাপনের কাজ করে থাকেন মূলত রাসেল রানা ও সোহেল রানা। 

এখনো পর্যন্ত এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ থেকে ৭০০’র বেশি ভিন্নধর্মী খেলার আয়োজন করা হয়েছে। দেশী দর্শকের পাশাপাশি বিদেশী দর্শকের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের এই ভিন্নধর্মী আয়োজনের গল্প। 

এক সময় এসব খেলা খেলানোর জন্য মানুষদের খুঁজে আনতে হলেও এখন চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেদিন যে গ্রামে খেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে সেদিন সে গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। খেলা দেখার জন্য ভিড় করে গ্রামবাসী। 

ওমর সানি জানান, “খেলাগুলো যখন হয় তখন সবার মনে একটা অন্য রকম আনন্দ কাজ করে। এজন্য ভালো লাগাটা আরো কয়েকগুণ হয়ে যায়। আমাদের পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে আরো অনেক জায়গায় এসব খেলা আয়োজন করার এবং আরো বেশি পুরস্কার দেওয়ার।“ 

বর্তমানে এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের ইউটিউব ভিডিওর সংখ্যা প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। এছাড়াও চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। তাদের ফেইসবুক পেইজেও রয়েছে ৩৬ লাখ অনুসারী যারা নিয়মিতই এসব ভিডিও দেখে থাকেন। তাদের আরেক চ্যানেল উই এক্সপ্লোরের ভিডিও সংখ্যাও প্রায় ৫০০’র কাছাকাছি। এই নামের ফেইসবুক পেইজেও রয়েছে প্রায় ১১ লাখ অনুসারী। 

মোঃ ওমর সানি সম্রাটের এই উদ্যোগ শুধু তাকেই সাবলম্বী বানায়নি বরং তার গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামের হাজারো মানুষকে দিয়েছে প্রয়োজনীয় সহায়তা। একই সাথে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করার মতো এরূপ উদ্যোগ বাংলাদেশে বিরল। 

[email protected] 

শেয়ার করুন