প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
প্রকৃতিতে বর্ষা মানে নব জীবনের সঞ্চার। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে যখন জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, সেসময় একটু স্বস্তির আবহ নিয়ে হাজির হয় ঋতুর রাণী খ্যাত বর্ষাকাল। সৃষ্টির খেলায় উন্মত্ত হয়ে প্রকৃতি তখন ফিরে পায় যৌবন, মানবমনে জেগে ওঠে সুখ-বিরহের নতুন পরশ।
যুগ যুগ ধরে বর্ষা তার স্ব-মহিমায় উজ্জীবিত করেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে যখন প্রকৃতিতে বৃষ্টি নামে, তখন মানবমন কিছুটা ভাবুক হওয়াই স্বাভাবিক। অজান্তেই তখন মন ছুটে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর সুখময় স্মৃতির আঙ্গিনায়। রবি ঠাকুরের ভাষায়, “আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে, জানিনে জানিনে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না লাগে না।”
বর্ষার আসল রূপ দেখা যায় গ্রামে। গ্রীষ্মের তাপদাহে জীর্ণ-শীর্ণ গাছপালাগুলো বর্ষার আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে সতেজ হয়ে ওঠে। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী, খাল-বিলও তার হারানো যৌবন ফিরে পায়। প্রকৃতিতে তখন কেবলই সৃষ্টির জয়জয়কার।
বসন্তে হরেক রকমের ফুল ফুটলেও বর্ষাও কিন্তু এক্ষেত্রে কম যায় না। বিস্তীর্ণ জলাশয়গুলোতে জাতীয় ফুল শাপলা কিংবা পদ্ম ফুলের উপস্থিতি আপনাকে সে কথাই জানান দেবে। এছাড়া পথের ধারে ফোটা কেয়া ফুলের প্রাণবন্ত রূপ বিমোহিত করবে যে কোনো পথিককে। অন্যদিকে থরে থরে ফুটে থাকা কদম ফুল মনে জাগায় প্রেমের স্পন্দন। পাশাপাশি বর্ষার অন্যান্য ফুল যেমন- কামিনী, করবী, বকুল, হিজল, জারুল, রঙ্গন ইত্যাদিও কিন্তু কোনো অংশে কম যায় না।
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলেনি এমন বালক খুব কমই আছে। শহর কিংবা গ্রাম উভয় জায়গাতেই বৃষ্টির দিনে এ খেলাটি একটি নিজস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে এসময় প্রায়ই কিশোরদের বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি খেলতে দেখা যায়। এ সময় হরহামেশাই ছোট ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে দলবেঁধে বিভিন্ন ঘরোয়া খেলায় অংশ নিয়ে থাকে।
নগরজীবনে বর্ষার দিনে রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা থাকলেও গ্রামে সে চিত্র কিছুটা ভিন্ন। খুব দরকার ছাড়া এ সময় সাধারণত ঘর থেকে বের হয় না মানুষজন। তবে সন্ধ্যায় পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায়। গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে এসময় মানুষের সংখ্যা বাড়তে থেকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গ্রামবাসী এসময় মেতে ওঠে খোশগল্পে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পল্লীবধূরা এসময় নকশীকাঁথা সেলায়। কখনো একা কিংবা কখনো দলবেঁধে এ কাজ করে থাকেন তারা। সূচের প্রতিটি ফোঁড়ে তারা তুলে ধরেন বাহারি সব নকশার বুনন।
মানবমনে প্রেমের সঞ্চারেও কিন্তু বর্ষা অন্য ঋতুর চেয়ে এগিয়ে। প্রকৃতিতে যখন অঝোর ধারা বয়ে যায়, মন খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়জনকে। হাজারো কথা এসে জমা হতে থেকে মনের কোণে। তাই তো বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙ্গালির প্রেমের কবিতা।” আবার রবী ঠাকুর লিখেছেন, “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়। এমন দিনে মন খোলা যায়, এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে তপনহীন ঘন তমসায়।”
শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বর্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এসময় মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির যোগান তৈরি হয় যা গাছপালা ও ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। বর্ষায় উপচে পড়া নদীতে তলিয়ে গিয়ে ফসলি জমি পায় নতুন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ। এছাড়া বাজারে কিছু বর্ষাকালীন ফল ও সবজিও দেখা যায় যা স্বাদের দিক দিয়ে যেমন অনন্য, তেমনি পুষ্টিগুণেও বেশ সমৃদ্ধ।
পাশাপাশি জলাশয়গুলোতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বলে মাছের বেড়ে ওঠার পক্ষেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে নদ-নদীগুলো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠায় তা নদীপথে যাত্রী কিংবা ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তবে বর্ষার অনেক সুবিধা থাকলেও এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। শ্রমজীবী মানুষদের এ সময় কাজ করতে বেগ পেতে হয়। গ্রামের অনেক রাস্তাঘাট পাকা সড়ক না হওয়াতে প্রায়ই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ছন কিংবা টিনের ঘরে বর্ষার পানি ঢুকে পড়ে। অত্যধিক বৃষ্টির ফলে বন্যা সৃষ্টি হয় যা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়ানো ছাড়াও ফসল এবং সম্পদ বিনষ্ট করে। এছাড়া এসময় প্রায়ই বিষাক্ত সাপ ও জোঁকের প্রকোপ বেড়ে যায়।
বর্ষার কিছু অসুবিধা থাকলেও মানুষ প্রতি বছর সানন্দে বরণ করে নেয় বর্ষাকে। এর রূপ, রস বিমোহিত করে মানুষকে। তাই তো ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি সব জায়গাতেই স্থান করে নিয়েছে বর্ষা।
তানজিম হাসান পাটোয়ারী বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের এমবিএতে অধ্যয়ন করছেন।
tanjimhasan001@gmail.com