ভূত চতুর্দশী : কেন খাওয়া হয় চোদ্দ শাক, জ্বালানো হয় চোদ্দ প্রদীপ?
প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
হিন্দু শকাব্দ তথা শালিবাহন শক পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালিয়ে ও চোদ্দ রকম শাক রান্না করে এদিন ভাতের সঙ্গে আহার করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ঘি-তুলসীপাতা দিয়ে কাজল পরানো হয় মেয়েদের কপালের বামে ও ছেলেদের কপালের ডানদিকে।
কিন্তু রোমাঞ্চকর এই আয়োজনের নেপথ্যে কী কারণ? তা জানা যায় পুরাণ থেকে। পুরাণমতে, দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করলে অসুরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তাকে থামানোর জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন অবতারে বলির কাছে চান তিন পা জমি। বলি এতে রাজি হন। বামন অবতারধারী বিষ্ণু দুই পা রাখেন স্বর্গ ও মর্ত্যে। তার নাভি থেকে বেরোনো তৃতীয় পা বলির মাথায় রেখে তাকে পাতালে পাঠান বিষ্ণু। তবে বিষ্ণুকে বলি জমি দান করায় প্রতিদান হিসেবে প্রতিবছর পৃথিবীতে পূজা পাওয়ার আশীর্বাদ করেন বিষ্ণু। সে মোতাবেক কালীপূজোর পূর্বের রাতে রাজা বলি পাতাল থেকে পৃথিবীতে আসেন পূজা নিতে। তার সঙ্গী হয়ে আসে হাজারো ভূত, প্রেত ও অশরীরী আত্মারা।
ভূত চতুর্দশী নিয়ে এর বাইরেও অপেক্ষাকৃত স্বল্পপ্রজ একটি মত আছে৷ সে মতানুযায়ী, চামুন্ডা রূপে মা কালী এ দিন চৌদ্দখানা ভূতকে সঙ্গে নিয়ে ভক্তদের বাড়ি থেকে অশুভ শক্তিকে দূর করতে পৃথিবীতে আসেন।
সনাতন ধর্মমতে, মৃত্যুর পর মানব দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। এই পঞ্চভূত হলো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। পঞ্চভূতে মিশে থাকা আত্মারা এ বিশ্বাস অনুযায়ী মর্ত্যে আসেন আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীর দিন৷ তাদের আনন্দের জন্য ও অতৃপ্ত আত্মাদের অভিশাপ দূর করার জন্য পূজার আয়োজন করা হয়।
প্রকৃতি থেকে সংগৃহিত ১৪ রকমের শাক পরলোকগত ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ বা নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়৷ ১৪ শাক ধুয়ে নিলে সেই জল ঘরের সব কোণায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রেত ও অশুভ শক্তির কুপ্রভাব দূর করতে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালান সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
শাস্ত্রমতে, এই ১৪ শাকের ভেতর রয়েছে- জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, পলতা, শুলকা, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণী শাক। এই শাকগুলো একত্রে মিশিয়ে রেঁধে খাওয়া হয়।
প্রখ্যাত স্মৃতি শাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য 'কৃত্যতত্ত্ব'-এ প্রাচীন গ্রন্থ 'নির্ণয়া-মৃত' এর অনুসরণে শ্লোকের মাধ্যমে এই ১৪ প্রকারের শাকের কথা উল্লেখ করেছেন৷
এদিন যে ১৪ টি প্রদীপ জ্বালানো হয় তার ভেতর রয়েছে মৃত্যুর দেবতা যমরাজকে উৎসর্গ করে জ্বালানো প্রদীপও। যম রাজের নামে আটা দিয়ে চতুর্মুখী প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির প্রবেশদ্বারে রাখেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এদিন প্রদীপ জ্বালানো হয় তিলের তেল দিয়ে৷ বাড়ির মূল দরজায় অল্প পরিমাণে চাল বা ধান রাখা হয়। তার ওপর রাখা হয় যমরাজের নামে জ্বালানো প্রদীপ।
এর পেছনেও রয়েছে পুরাণে বর্ণিত চমকপ্রদ এক কাহিনী। সে অনুযায়ী, যমরাজ একবার যমদূতদের জিজ্ঞাসা করেন, প্রাণহরণের সময় কারো প্রতি যমদূতদের মায়া জাগে কিনা৷ প্রথমে সবাই উত্তরে 'না' বলেছিলেন। তবে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসায় ভিন্ন উত্তর দেন তারা। পুরাণমতে, এক রাজার স্ত্রী 'হেম' ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। জ্যেতিষীদের গণনায় হেম জানতে পারেন তার পুত্র বিবাহের চারদিন পর প্রয়াত হবে। তাই পুত্রকে ছোট থেকেই ব্রক্ষ্মচারী হিসেবে গড়ে তুলছিলেন তিনি৷
রাজপুত্র যুবক বয়সে উপনীত হবার পর একদিন যমুনার তীরে মহারাজা হংসের পুত্রী ভ্রমণে আসেন। তাকে দেখে মুগ্ধ রাজকুমার গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেন তাকে৷ এর চারদিন পর জ্যেতিষীদের কথার সত্যতা মেলে- প্রয়াত হন রাজকুমার। রাজকন্যার গগণবিদারী ক্রন্দনে কেঁপে ওঠে যমদূতদের বুক, চোখ ভরে ওঠে জলে। তারা যমরাজের কাছে জানতে চান, এহেন মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? উত্তরে যমরাজ তাদের জানান, 'ভূত চতুর্দশী'র দিন নিয়ম মেনে পূজো ও প্রদীপ প্রজ্বলন করতে হবে। তবেই অকালমৃত্যু থেকে বাঁচা যাবে!
সেই থেকেই শুরু হয় ভূত চতুর্দশীতে ১৪ রকম প্রদীপ জ্বালানো ও ১৪ শাক খাওয়া।
আরেকটি মত অনুযায়ী, নরকাসুরকে এদিন বধ করেছিলেন কৃষ্ণ ও সত্যভামা। আর দানব রাজা বলির কথা তো লেখার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছেই। তার সঙ্গে পরিচারক হিসেবে আসা ভূত প্রেতদের ঘরে প্রবেশ ঠেকানোর জন্য শুরু হয়েছিলো প্রদীপ প্রজ্বলন- এমন মতও প্রচলিত আছে।
আর ১৪ শাক খাওয়ার পেছনে রয়েছে আবহাওয়া ও ঋতুগত কারণও। পুরাণে আশ্বিন ও কার্তিক মাসকে 'যমদংস্টাকাল' বলা হয়। এই দুই মাসে ঋতুগত কারণে অনেকে নানান রোগে ভোগেন। এ সময়ের জ্বরকে খুব কুখ্যাত বিবেচনা করা হতো। মনে করা হতো, যমরাজের নজর পড়ার কারণেই এসব রোগ-ব্যাধি হচ্ছে। এই ১৪ প্রকারের শাক যমের সেই প্রভাব তথা রোগ-ব্যাধি থেকে সুরক্ষায় ভালো ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করা হতো।
সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে ও ১৪ রকমের শাক খেয়ে পালন করে চলেছেন ভূত চতুর্দশী।
mahmudnewaz939@gmail.com