প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
দেশ হিসেবে আয়তনে যেমন বড় ভারত, তেমনি এর ভেতর আছে নানান জাতি, বর্ণ, ধর্মের মানুষের বাস। আধ্যাত্মিকতা, তন্ত্রসাধনা ও বৈচিত্র্যময় নানান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লীলাভূমি ভারত। আর এর চমকপ্রদ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রয়েছে শনি শিংনাপুর।
মহারাষ্ট্রে অবস্থিত এই গ্রামের দরজায় তালা-চাবি থাকা তো দূরের ব্যাপার, ঘরগুলোতে এমনকি নেই দরজাও! শুনতে খুবই অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য এই যে, এই গ্রামে আবহমানকাল ধরেই দরজা ছাড়া বাড়ি তৈরির রেওয়াজ চলে আসছে।
নেপথ্যে শনি দেবের মূর্তি
দরজা ছাড়া ঘর নির্মাণের এমন চমকপ্রদ কৌশল যেমন আছে, তেমনি এমন রীতির পেছনে আছে তাদের লালিত অদ্ভুত এক বিশ্বাস।
শনি দেবতার প্রতি গভীর আস্থা এই প্রথার নেপথ্য কারণ। সনাতন ধর্মীয় পুরাণ অনুসারে শনি গ্রহের অধিপতি দেবতা হলেন শনি দেব। এমন কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, বহু বহু শতাব্দী পূর্বে তীব্র প্লাবনে গ্রামটি একেবারে ভেসে যায়। বন্যার পানি নেমে গেলে দেখা যায় বড় আকারের একটি কালো পাথুরে স্লাব সেখানে রয়ে গিয়েছে।
এক রাখাল তার হাতে থাকা লোহার হাতিয়ার দিয়ে স্পর্শ করেন সেই কালো পাথুরে স্লাবটি। এরপর তাকে বিস্মিত করে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে রক্ত!
গ্রামবাসীদের মাঝে প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, সেই রাতে রাখালের স্বপ্নে আসেন শনি দেব। বলেন কালো ওই পাথুরে স্লাবটিতে খোদাই করা আছে তারই মূর্তি। পাথুরে এই কালো স্লাবটিকে গ্রামেই রাখতে বলেন শনি দেব। তবে শর্ত হলো, একে রাখতে হবে একদম মুক্ত। ওপরে কোনো ছাদ নির্মাণ করা বা চারপাশ ঘিরে সীমানা নির্মাণ করা চলবেনা।
তখন থেকে, সেই কালো পাথরখন্ড তথা শনি দেবের মূর্তিকে পুরোপুরি মুক্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে। প্রতীকীভাবে ব্যাপারটা এমন, শনি দেব মুক্ত অবস্থায় বিরাজ করে গ্রামের সকল অধিবাসীর খেয়াল রাখছেন। গ্রামবাসী বিশ্বাস করে, শনি দেব গ্রামের সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত করেছেন তার দৃষ্টি। শনি দেবের সুদৃষ্টি তাদের রক্ষা করবে সকল বিপদাপদ থেকে! বিশেষত শনি দেবের নজর থাকলে গ্রামে চোর-ডাকাতের উপদ্রব থাকবেনা- এমন বিশ্বাসও রয়েছে তাদের।
দরজা ও তালা-চাবি ছাড়াই বসবাস
কালো সেও পাথরখণ্ড, ছবি: আরভিএ টেম্পলস
বাইরের কারো চোখে ব্যাপারটাকে মনে হবে খুবই অদ্ভুতুড়ে। বাসা-বাড়ি, বিদ্যালয়, বাণিজ্যিক ভবন, এমনকি স্থানীয় ব্যাংকে পর্যন্ত নেই কোনো দরজা, আর তালা-চাবি থাকার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তবে দরজা যে একেবারে নেই, তা নয়। বাসাবাড়ির বাইরে ব্যাংক বা বাণিজ্যিকভবনে দরজা আছে, কিন্তু তা সবসময় খোলা থাকে। ভেতরে যা কিছু ঘটছে, তা যেন শনিদেবের দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়, তাই এমন ব্যবস্থা!
গ্রামবাসীর বিশ্বাস, কারো মনে যদি অসৎ কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তবে তার ওপর নেমে আসবে শনি দেবের আক্রোশ। তাই এই গ্রামে অপরাধ প্রবণতাও তেমন নেই। অল্প কয়েকটি চুরির ঘটনা এখানে ঘটতে গিয়েছে বিভিন্ন সময়, তবে চোর ধরা পড়েছে প্রতিবারই। গ্রামবাসীর কাছে এটিও 'সদাজাগ্রত' শনি দেবের লীলা। শনি দেবের কৃপায় চোরেরা ধরা পড়েছে ও কঠোর শাস্তি পেয়েছে বলেই বিশ্বাস শনি শিংনাপুর গ্রামের মানুষদের।
পর্যটনের জন্য অভিনব স্থান
প্রতি বছরই হাজারে হাজারে মানুষ ঘুরতে আসে এই গ্রামে। অবাক বিস্ময়ে পর্যটকেরা দেখেন দরজা ছাড়া, তালা-চাবি ছাড়াই বিচরণ ও জীবনযাপন করছে মানুষ। যুক্তির বিচারে এমন বসবাস খুবই অনিরাপদ। তবে গ্রামবাসী নিরাপত্তার আধুনিক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্যি বাস করছে এই গ্রামে।
গ্রামে তৈরি করা হয়েছে শনি দেবের মন্দির। সেই কালো পাথরের স্লাবটি বসানো হয়েছে এর কেন্দ্রে। এখানে আসা পুণ্যার্থি ও পর্যটকদের কাছে এটিই প্রধান দর্শনীয় বস্তু।
সাধারণত, কোথাও অবস্থান বা বসবাসের জন্য নিরাপত্তার প্রশ্নটিই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। আর এমন অনিশ্চয়তার যুগেও শনি শিংনাপুর দাঁড়িয়ে রয়েছে সৌন্দর্যপূর্ণ, দৃঢ় এক ব্যতিক্রম হয়ে ; বিশ্বাস কতটা শক্তিশালী হতে পারে-যেন তারই প্রমাণ দিচ্ছে।
mahmudnewaz939@gmail.com