Bangla
7 days ago

যে কারণে হয়েছিল বাংলা ভাগ?

প্রকাশিত হয়েছে :

সংশোধিত :

সময়টা তখন ১৯০৫ সাল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে কলকাতা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রস্থল। শিক্ষাব্যবস্থার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে ছিল এই শহরটি। আর তাই তো একটি লম্বা সময় যাবত সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল কলকাতা।

সেসময় পূর্ব বাংলা থেকে বহু শিক্ষার্থী এবং বণিক শ্রেণী কলকাতায় পাড়ি জমায়। এরই ফলশ্রুতিতে তৎকালীন সরকারের বাজেটের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকতো পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা।

বছরের পর বছর এভাবে চলার পর একসময় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মানুষের জীবনযাত্রায় বৈষম্য প্রকট হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যেতে থাকলেও তার সিকিভাগ উন্নয়নের ছোঁয়াও লাগেনি পূর্ববঙ্গে।

এছাড়া আবহাওয়াজনিত কারণে পূর্ববঙ্গের মাটি বরাবরই চাষাবাদের জন্য উপযোগী ছিল। অথচ দেখা যেত এ অঞ্চল থেকে অর্জিত আয়ের মোটা অংশই চলে যেত কলকাতার উন্নয়নে।

জাতিগত ক্ষেত্রেও তীব্র বৈষম্য পরিলক্ষিত হতো এই দুই বাংলার মানুষের মাঝে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলায় সনাতন সম্প্রদায়ের জাত প্রথা নিয়েও বৈষম্য দেখা যেত। তৎকালীন সমাজে জাতপ্রথার প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। ফলশ্রুতিতে পূর্ব বাংলার হিন্দু সমাজের প্রতি পশ্চিম বাংলার হিন্দু সমাজের এক ধরণের তাচ্ছিল্য ছিল যা এখানকার হিন্দুদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

এসব কারণে পশ্চিম বাংলার প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের মনে এক ধরনের ক্ষোভ জন্মায় যা বঙ্গভঙ্গের পেছনে একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশাপাশি পূর্ব বাংলার জনগণ থেকে সরকার বিপুল অর্থ কর হিসেবে আদায় করলেও উন্নয়ন বাজেট হিসেবে তার বেশিরভাগই বরাদ্দ পেত পশ্চিমবঙ্গ। এসব কারণে এই জনপদের মানুষের মনে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়তে থাকে।

এছাড়া প্রশাসনিক কাঠামোগত কারণও ছিল বঙ্গভঙ্গের পেছনে হাতিয়ার। আয়তনে বড় হওয়ার কারণে এত বড় জনপদকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিচালনা করা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া পূর্ববঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছোঁয়াও ছিল অত্যন্ত নগণ্য।

যেহেতু তখন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কলকাতায় বসবাসের উপর বেশি গুরুত্ব দিত, তাই সরকার সেখানকার রাস্তাঘাট কিংবা অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি বাজেট দিত।

পক্ষান্তরে পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম বাড়তে থাকে।

এসব কারণে একসময় সরকার দুই বাংলাকে আলাদা করার পরিকল্পনা করতে থাকে। কারণ অন্যথায় পূর্ব বাংলার অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো ব্রিটিশ সরকারের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হতো।

তবে শুধু পূর্ব বাংলার উন্নয়নের জন্যই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করেছিল এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না। যেহেতু শিক্ষায় কলকাতা অনেকটুকু এগিয়ে ছিল তাই সেখানে একটি শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে যাদের মধ্যে যারা ক্রমশ স্বাধীনচেতা হতে শুরু করে।

একসময় তারা ধীরে ধীরে ভিনজাতির শাসনের বিরুদ্ধে অনীহা দেখাতে থাকে যা ব্রিটিশ সরকারেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই তারা দুই বঙ্গের মাঝে এক ধরনের ফাটল ধরাতে চেয়েছিল যাতে করে পশ্চিম বাংলার মানুষের মনোভাব পূর্ব বাংলায় না আসতে পারে।

এছাড়া জাতপ্রথার সূত্র ধরে পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে পশ্চিম বাংলার হিন্দু সমাজের প্রতি জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে করে পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও বঙ্গভঙ্গের প্রতি সায় দেয়।

অবশেষে ১৯০৫ সালের ৯ জুন এই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয় যা একই বছরের ১০ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সেই বছরের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়িত হয়।

তখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, আসাম, ত্রিপুরা ও মালদা মিলে গঠিত হয় একটি নতুন প্রদেশ যার নাম হয় পূর্ব বাংলা ও আসাম। এই প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে তৈরি হয় বাংলা প্রদেশ যার রাজধানী হয় কলকাতা। তবে বঙ্গভঙ্গের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই কলকাতার বণিক শ্রেণী এর বিরোধীতা করে আসছিল। কারণ তাদের ধারণা ছিল পূর্ববঙ্গ আলাদা হলে পশ্চিমবঙ্গের বাজেট কমে যাবে।

পূর্ব বাংলার জনগণ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এর বিরোধিতা করতে থাকে। সেই সময় বেশ কিছু আন্দোলনও গড়ে উঠে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় এবং দিল্লিকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

tanjimhasan001@gmail.com

শেয়ার করুন