প্রকাশিত হয়েছে :
সংশোধিত :
‘লিপস্টিক’ শব্দটি শুনেই আমাদের চোখে হাসি ভরা রঙিন ঠোঁটের কোনো এক নারী মুখ ভেসে উঠে । শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অধিকাংশ নারীর প্রিয় প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে উপরের দিকে স্থান করে আছে লিপস্টিক।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে প্রাচীনকালে লিপস্টিক আবিষ্কারের সময় এটি নারী পুরুষ উভয়েরই ব্যবহারের উপাদান ছিল। এটি শুধু প্রসাধনী হিসেবেই নয়, ঔষধি হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
তবে তখন লিপস্টিক শব্দটির সাথে মানুষ পরিচিত ছিল না। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা গাছের ছাল, সীসা, মেহেদি, জামের রস, ফুলের রস, পান পাতা, মাটি থেকে রঙ তৈরি করে ঠোঁটে লাগাতো। এই রঙ গুলো ঠোঁটে আটকানোর জন্য আঠা ব্যবহার করতো।
মেসোপটেমীয় সভ্যতার এক শ্রেনির মানুষ ঠোঁটে লাগানোর জন্য ব্যাবহার করত রত্নচূড়। এছাড়া মিশরীয় ও রোমানরা রঞ্জক পদার্থ, যেমন - এলজিন, আয়োডিন, ব্রোমিনের সংমিশ্রণে রঙ প্রস্তুত করে ঠোঁটে লাগাতো। ফারাও রাণী ক্লিওপেট্রা গাঢ় লাল রঙ ব্যাবহার করতেন ঠোঁটে। তখনকার সময়ে মৃত কীট থেকেও রঙ সংগ্রহ করা হতো।
১৯৮০ সালে প্রথম লিপস্টিক নামে নামকরণ করা হয় ঠোঁট রঙিন করার এই প্রসাধনীকে। ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের একটি সুগন্ধি তৈরির কোম্পানি প্রথম বানিজ্যিকভাবে এই লিপস্টিক বাজারে আনে।
তখন এই লিপস্টিক ধাতব কৌটায় পাওয়া যেত না। তরল বা ঘন রঙের লিপস্টিক কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যেত। ধাতব দন্ডে লিপস্টিকের আবির্ভাব ঘটে আরো পরে, ১৯১৫ সালে মরিস লেভির হাত ধরে। আধুনিক কালের এই লিপস্টিক তার হাত ধরেই অগ্রসর হয়। বর্তমানে আমরা যে লিপস্টিক চিনি, তার নাম ‘সুইভেল আপ’ লিপস্টিক।
তবে লিপস্টিকের অগ্রগতির পথে নানা সময়ে এসেছে বাধা। একসময় গ্রিসে যৌন কর্মীদের এই রঙ ঠোঁটে ব্যাবহারের নির্দেশ ছিল। ঠোঁটের গাঢ় রঙই তাদেরকে শনাক্ত করার উপায় ছিল।
খ্রিস্টান ধর্মের নিয়মকানুন থেকেও লিপস্টিকের ব্যবহারে বাধা আসে। লিপস্টিক ব্যাবহারকে তারা শয়তানের কাজ বলে নিষিদ্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে পোপের মাধ্যমে প্রসাধনী সামগ্রী ব্যাবহারে নানা নীতিমালা আসে। এতে লিপস্টিকের ব্যাবহার পুরোপুরি বন্ধ না হলেও লাল রঙের লিপস্টিক ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হয়, দেয়া হয় গোলাপি লিপস্টিক ব্যাবহারের অনুমতি।
তারপর রাণী প্রথম এলিজাবেথের সময়ে লিপস্টিক ব্যাবহার আবার কিছুটা বেড়ে যায়। রানী ঠোঁটে রঙ লাগানো খুবই পছন্দ করতেন। ফলে সাধারণ নারীরাও ধর্মীয় নির্দেশ অমান্য করে এই প্রসাধনী ব্যাবহারে আগ্রহী হয়।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সময়ে নারী পুরুষ উভয়ের মাঝেই ব্যাপক ভাবে লিপস্টিক ব্যাবহারের প্রচলন ছিল। প্রধান কারন, থিয়েটারের আবির্ভাব। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময়েও পুরুষদের মধ্যে লিপস্টিকের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। লিপস্টিকের জনপ্রিয়তার সত্ত্বেও ধর্মীয় দিক থেকে এটি কঠিন ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এর ব্যাবহার জাদুবিদ্যার প্রসার, শয়তানের কাজ, যৌনকর্মীদের প্রসারের প্রতীক মনে করা হতো।
তবে রাণী ভিক্টোরিয়ার সময়ে নারীবাদ ডানা মেলতে শুরু করে, তারা কী পরিধান করবে, কোথায় কাজ করবে, ভোটাধিকারসহ নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে। একসময় লিপস্টিক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
বর্তমানে অনেক নামি-দামী ব্র্যান্ড লিপস্টিক তৈরি করে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ফর্মুলায় তৈরি বিশ্বজুড়ে পরিচিত কিছু লিপস্টিক ব্র্যান্ড হলো - লরিয়েল, কালার পপ, ম্যাক, ওয়েট এন্ড ওয়াইল্ড, ইত্যাদি। এছাড়া ফ্রান্স, চিন, জার্মানিসহ নানা দেশ বর্তমানে সুলভ মূল্যে নানা রঙের লিপস্টিক উৎপাদন করছে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী নাওশিন মুশতারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।