উঠন্তি মুলো যেমন পত্তনেই চেনা যায়, পপসম্রাট আজম খানের শিল্পী জীবনের পূর্বাভাসও মিলেছিল আজিমপুর সরকারি কলোনির ১০ নম্বর কোয়ার্টারে বেড়ে ওঠা সেই ছেলেটির মধ্যে। যে কিনা বন্ধুদের আসর মাতিয়ে রাখতো দেশ-বিদেশের বহু গানে। গানের প্রতি আগ্রহ মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সে পাড়াতো ভাই-বন্ধুদের সাহচর্য ও চর্চায় সে আগ্রহ ক্রমশ বেড়েছে। এরপর সঙ্গীত জগতে তার পথচলাও থামেনি।
আজম খান জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি। কিশোরকাল থেকেই দেখেছেন দেশের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আপাত সাধারণ এই মানুষটির জীবন পরিপূর্ণ ছিল একের পর এক লড়াইয়ে। লড়বার শক্তিও ছিল প্রচুর।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকালে গণসঙ্গীতের হাতিয়ার কণ্ঠে নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে ক’জন রাজপথে নেমেছিলেন, আজম খান তাদের মধ্যে অন্যতম। সেসময় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ছিলেন এক নির্ভীক গেরিলা যোদ্ধা। প্রাণ বাজি রেখে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে ফিরে আসেন। ফিরে এসে অংশ নেন আরেক ব্যক্তিগত লড়াইয়ে। দেশীয় গানের ধারায় পাশ্চাত্য ধাঁচের সংযোজন তখনো প্রচলিত নয় এখানে। তিনি ধীরে ধীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন। একে একে উপহার দিলেন মনে থেকে যাবার মতো গান। গল্প শোনালেন আলাল-দুলাল, সালেকা-মালেকাদের, চানখারপুলের রিকশাওলাকে গড়ে তুললেন নিজের গানের চরিত্র হিসেবে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে আমৃত্যু একাকী জীবন কাটান এই শিল্পী। এই একাকিত্বের ছোঁয়া পেয়েছে তার গানের কথাও– ‘একা লাগে যখনই, তোমাকে খুঁজি আমি’। তবে একই পৃথিবীতে থেকেও যারা অন্য ‘সুখের ভিড়ে’ চলে যায়, তাদের মনে করে যে ‘ব্যথার দিন’ গোনা হয়, সে ব্যথাও এসেছে তার গানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায় মাঝরাতে গায়কমন ঘটা করে ভাবতে বসে, ‘পাপড়ি কেন বোঝে না?’, হয়তো ‘তাই ঘুম আসে না’। এমন ঘুম না আসা শত প্রেমিকের হৃদয় ভাঙার গল্প শোনা যায়, আজম খানের লেখায়, কণ্ঠে। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন, আরো একটু সাধারণের।
শিল্পের সাথে মানুষ সবচেয়ে বেশি চায় তার নিজের সংযুক্তি। শিল্পকে নিজের মধ্যে অনুভব করাই শিল্পকে আরো কাছে নিয়ে আসে। কেননা নিজের সাথে মিলিয়ে ফেলার স্বভাব মানুষের বড় চিরচেনা। আজম খানের গান শুনলে প্রায় শ্রোতারই মনে হবে, এ গান তো তারই। তাতেই স্বার্থকতা পায় শিল্প, শিল্পী নিজেও।
২০১১ সালের ৫ জুন পৃথিবীর সীমানা ভেদ করে পাড়ি দেন অন্য জগতে, যে জগত আমরা এখনো চিনি না। হয়তো অজানা সেই পথে যাবার বেলায়, মনের ভুলে সেদিনও গুনগুন করতে চেয়েছিলেন, ‘এই গান শেষ গান, আর বুঝি গাওয়া হবে না।’ তবে মৃত্যু নামের মানবজীবনের এই ধ্রুব সত্যকে বিদায়ক্ষণের বহু আগেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন তিনি, তার গানেরই কথায়–
‘এই মায়াভরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব চিরতরে–
সবাই চলে যায়, কতটুকুই বা পায়?’
এ ধরাধামে কে কতটুকু পায়, জানা হয় না। তবে বাংলা গানের জগত পেয়েছিল তার পপ সম্রাটকে, একজন আজম খানকে।