বাংলাদেশের সরকারি চিকিৎসকদের সরকার কর্মসময়ের পর হাসপাতালেই ব্যক্তিগত রোগী দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। ১ মার্চ থেকে শুরু হবে এই ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’, তা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হল চিকিৎসকদের তাদের কর্মস্থলে রাখা, তরুণ চিকিৎসকদের প্র্যাকটিসের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।
তবে তার এই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে ‘চেম্বার’ করে রোগী দেখার সুযোগ দেওয়া হলে নবীন চিকিৎসক এবং কিছু রোগী কিছুটা সুবিধা হয়ত পাবেন, তবে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের এতে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম।
আবার সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করে বেরসরকারি সেবার চর্চা কতটা বিধিসম্মত হবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
সরকারের বেতনভুক্ত চিকিৎসকরা তার কর্ম সময়ের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার সুযোগ পান। তারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত চেম্বার বসিয়ে ফির বিনিময়ে রোগী দেখে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ) প্রথম হাসপাতালেই চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত রোগী দেখার সুযোগ করে দেয়। স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানের পর বেসরকারি বারডেমও একই পথ অনুসরণ করে।
এখন সরকারি হাসপাতালেও একই ধারা চালু করতে চাইছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ হাসপাতালে সকালে রোগী দেখার পর বিকালে চিকিৎসকরা ফি নিয়ে রোগী দেখবেন।
এই ধরনের চর্চা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চললেও সরকারি হাসপাতালে চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন ডা. রশীদ ই মাহবুব।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই সভাপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি হাসপাতালে বসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে টাকা নেওয়া, হাসপাতালের নিয়মিত কাজের বাইরে কাজ করা, এর বৈধতা কে দেবে? সরকারি হাসপাতালে পয়সা নিয়ে রোগী দেখা আগেও অবৈধ ছিল, এখনও আছে। এটা তো একটা অফেন্স।”
এর ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “চিকিৎসকরা এটা শুরু করলে তো পুলিশ থানায় বসে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য টাকা নেবে, ইঞ্জিনিয়ার তার অফিসে বসে প্ল্যান পাস করবে, ভেটেরিনারি সার্জন, কৃষিবিদরাও প্র্যাকটিস করবেন। তাহলে সরকারের কাজটা কে করবে?”
হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে দেওয়ার অনুমোদন সার্ভিস রুলে নেই উল্লেখ করে রশীদ ই মাহবুব বলেন, “এটা করলে স্বাস্থ্য সেবায় কী পরিবর্তন আসবে, তা তার কাছে বোধগম্য নয়।”
নতুন নিয়মে তরুণ চিকিৎসক ও রোগীরা উপকৃত হবেন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড.আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা (তরুণ চিকিৎসক) প্র্যাকটিস করে ওষুধের দোকানে গিয়ে বা প্রাইভেট ক্লিনিকে নাইট শিফটে ডিউটি করে। বাইরে রোগী দেখার চেয়ে মেডিকেলে রোগী দেখলে তাদের লাভ হবে।
“রোগীরা বাইরের চেম্বারে ৫০০ টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতেন, এখানে ২০০ টাকায় দেখাতে পারবেন। রোগীদের ডাক্তার খুঁজতে হবে না।”
তবে বিশেষজ্ঞ জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের পাওয়ার সম্ভাবনা কম দেখছেন ড. জামিল।
তিনি বলেন, বিএসএমএমইউর বহির্বিভাগে বৈকালিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো চালু হলে শুরুতে অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক রোগী দেখতেন। এখন আর তারা বসেন না।
“নানা অজুহাতে তারা বসেন না। নিজেদের চেম্বারে রোগী দেখেন। এখানে বসলে পাবেন ২০০ টাকা, বাইরে গেলে পাবেন ১ হাজার টাকা। এজন্য ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে চিকিৎসকরা যে খুব হাসপাতালমুখী হবেন, সে সম্ভাবনা কম।”
ঢাকার বাইরের একটি জেলা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক এক্ষেত্রে নানা সঙ্কটের কথা বলেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে করা সম্ভব। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে করতে গেলে আমার যে লোকবল সকালে আছে, বিকালেও তা থাকতে হবে। দেখা গেল বিকালে আমার কাছে একজন রোগী এল, যার সিজার করতে হবে। আমি কি সেটা পারব? আমার ওটির লোকবল লাগবে না? এই বিষয়গুলো ভাবতে হবে।”
চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকদের সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাচিপও মতামত দিয়েছে।
“আমাদের কথা ছিল, কোনো রোগী বিকালে হাসপাতালে এসে সিনিয়র চিকিৎসক পায় না- এমন ঘটনা যেন না ঘটে। স্বল্প মূল্যে যেন একজন সিনিয়র চিকিৎসককে দেখাতে পারেন রোগীরা।”
বিএসএমএমইউর ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই আছে। নিয়মটি চালু করলে এর নেতিবাচক বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
এই নিয়ম করলে হাসপাতালের দালালদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
ডা. স্বপ্নীল বলেন, “সকালে আউটডোরে আসা রোগীকে বিকেলে বড় ডাক্তার দেখানোর কথা বলে দালাল প্রতারণা করতে পারে। এজন্য হাসপাতালের স্টাফরা যেন কোনো মনোপলি না করতে পারে সে বিষয় কঠোর নজরদারি করতে হবে।”
যা বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
গত ২২ জুন চিকিৎসকদের নানা সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের পরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, মার্চ মাস থেকে সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসকদের রোগী দেখা শুরু হবে। এতে চিকিৎসক নেতারা সম্মত হয়েছেন।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, কাজটি শুরু করতে ‘খুব তাড়াতাড়ি’ একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে।
পাইলটিং হিসেবে দেশের ৫০টি উপজেলা, ৩০টি জেলা এবং পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই কার্যক্রম প্রথম শুরুর পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে জাহিদ মালেক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা হলে নবীন চিকিৎসকরা যেমন সুযোগ পাবেন, তেমনি রোগীরা উপকৃত হবেন।
“সিনিয়র ডাক্তাররা নাম করেছে, এজন্য তারাই বেশি রোগী দেখে। কিন্তু আমাদের উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের তরুণ চিকিৎসকরা সে সুযোগ পায় কম।”
চিকিৎসকরা বিকালে রোগী দেখতে বাধ্য থাকবেন কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা সিনিয়র ডাক্তারদের জন্য এটা বাধ্যতামূলক করব না। জুনিয়র ডাক্তারদেরও আমরা কিছু জায়গায় অপশনাল থাকবে, কিছু জায়গায় আমরা তাদের বলব, এটা করেন।।”
বাংলাদেশে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় ১৯৮২ সালের দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরি (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী।
ওই অধ্যাদেশের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার নিবন্ধিত চিকিৎসকরা তাদের অফিস সময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না।
নতুন নিয়মটি সরকারি সুবিধা নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস হয়ে যায় কি না-এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে বাধা নেই। সেটা হাসপাতালে করুক আর বাইরে করুক।
“তো আমাদের নিজের চেম্বারে বসে করলে তো অসুবিধা নাই। আমরা মনে করি যে এটা করলে হাসপাতালে ডাক্তারের অ্যাভেইলেবলিটি বাড়বে, রোগীদের সেবা পাওয়াও বাড়বে। হাসপাতালের অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য রোগীরা যে ফি দেবে, তার একটা অংশ হাসপাতালও পাবে। সেটা থেকেই হয়ে যাবে।”
জাহিদ মালেক বলেন, মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি কীভাবে হবে, তার বিস্তারিত একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।
“কারা কারা এতে থাকবেন, কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, এর খরচ কী হবে, এটা চালাতে খরচ হলে সেটা কীভাবে বহন করা হবে? এগুলো ঠিক করা হবে।”
যেমন চলছে বিএসএমএমইউউতে
২০১১ সালে বিএসএমএমইউর বহির্বিভাগে বিশেষায়িত চেম্বার সুবিধা চালু করে দেশের চিকিৎসা শিক্ষার সর্বোচ্চ এই প্রতিষ্ঠানটি।
শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখেন। ২০০ টাকার টিকেট দিয়ে ২৪টি বিভাগের চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারেন রোগীরা।
বিএসএমএমউর বৈকালিক বহির্বিভাগে মাসিক সূচি অনুযায়ী, প্রতিদিন একটি বিভাগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখেন।
বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউর বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, গাইনি বিভাগের জানুয়ারি মাসের চিকিৎসকদের যে সূচি তাতে ১০ জন অধ্যাপক রোগী দেখবেন। অর্থোপেডিক বিভাগে অধ্যাপকরা সাত দিন, কার্ডিওলজি বিভাগে সাত দিন, জেনারেল সার্জারি বিভাগে সাত দিন, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে ৭ দিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহেবিলিটেশন বিভাগে ১৩ দিন, কিডনি বিভাগে ১৬ দিন, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সপ্তাহের তিন দিন অধ্যাপকরা রোগী দেখবেন।
বিএসএমএমইউ এই বহির্বিভাগে আসা রোগীরা জানিয়েছেন, সকালের বহির্বিভাগে সাধারণত কনসালটেন্ট এবং সহযোগী অধ্যাপকরাই রোগী বেশি দেখেন। বিকেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসেন, এজন্য এসময় ভিড়ও হয় বেশ।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইন্স এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসক দেখাতে। এ সময়ে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সময় সিনিয়র ডাক্তাররা বসেন।”
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা এনায়েত হোসেন জানান, মেডিসিন, নিউরো মেডিসিন এবং নিউরো সার্জারির মতো বিভাগগুলোয় রোগীদের ভিড় বেশি। এজন্য টিকেটের জন্যও দুপুরের আগে থেকেই লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।
“সকালে জুনিয়র ডাক্তাররা দেখেন, সময়ও দেন খুব কম। কিন্তু বিকেলে এখানে অধ্যাপকরা বসেন, একটু বেশি সময় নিয়ে দেখেন। তবে টিকেটের জন্য ব্যাপক ভিড় হয়। এই সুযোগে দালালরা এসে জানতে চায় টিকেট নিব কি না, ২০০ টাকার টিকেট ৪০০ টাকা। আমি নেই নাই, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট নিছি।”
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোন চিকিৎসক কবে বৈকালিক বহির্বিভাগে রোগী দেখবেন, তা ঠিক করে দেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান।
এসময় নেওয়ার ফি বণ্টিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “রোগী দেখা বাবদ পাওয়া অর্থ চিকিৎসক, হাসপাতাল এবং অন্যান্য কর্মচারী যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হয়।”