Bangla
3 years ago

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সামনে কী

ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

Published :

Updated :

সংক্রমণের গ্রাফ উঠছে-নামছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষা যেন আর ফুরাচ্ছে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কেবলই বাড়ছে।

মহামারীতে শিক্ষাপঞ্জি ভেস্তে যাওয়ায় সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে ক্লাস নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় বসানোর কথা বলছিল সরকার। কিন্তু সেই ক্লাস শুরুর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দিকে।

এই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ালেখায় মনোযোগ ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়েছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাদের প্রশ্ন রয়েছে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি নিয়েও। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ভাবতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। কেউ কেউ দ্রুত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরুর পক্ষে, আবার অনেকের মধ্যে সে বিষয়ে দ্বিধা আছে।

মহামারীর কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফা খোলার পরিকল্পনা নিয়েও মহামারী পরিস্থিতির কারণে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে।

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে চলমান লকডাউনের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানো হয়েছে আগামী ২৯ মে পর্যন্ত।

কর্তৃপক্ষ বলছে, মহামারী পরিস্থিতির উপরই নির্ভর করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়সূচি। সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর আরও আড়াই মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে শিক্ষার্থীদের।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ক্লাস নিয়ে পরীক্ষা নেব। অটো পাস দেব না। প্রতি বিষয়ে এসএসসিতে ৬০টি ক্লাস ও এইচএসসিতে ৮০টি ক্লাস নিয়ে আমরা পরীক্ষাটা নেব।”

এই ক্লাস শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বসতে হবে বলে পরিকল্পনা করেছেন তারা।

সে হিসেবে ২৯ মের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও অগাস্টের শেষভাগের আগে পরীক্ষা আয়োজনের সুযোগ থাকছে না।

ভবিষ্যত কোন পথে

মহামারীর আগে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি এবং এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০২০ সালের মার্চে দেশে যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিল, তার আগেই এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা আটকে যান।

বছরের শেষে এসেও স্কুল-কলেজ খুলতে না পেরে শিক্ষার্থীদের সবাইকে পরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ফল প্রকাশ করা হয় তাদের এসএসসি ও জেএসসির ফলের গড় করে।

তখন যুক্তি ছিল, মহামারী শুরুর আগেই এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি শেষ হয়ে যাওয়ায় একেবারে না শিখে তাদের পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকছে না। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। 

পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, এসএসসি পরীক্ষার্থীরা মহামারীর আগে নবম শ্রেণির পাঠ শেষ করলেও দশম শ্রেণিতে ক্লাস করতে পেরেছে মাত্র কয়েকদিন। আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষও শেষ করতে পারেনি।

অনলাইনে ক্লাস চললেও তাতে দশম ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীরা কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে, সে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এবার আর শিক্ষার্থীদের ‘অটো পাস’ দিতে রাজি নয় সরকার।

বিকল্প হিসেবে এসএসসিতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিষয় রেখে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। সেই পাঠ্যসূচিতেই তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংশয় কাটছে না।

কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী সৈয়দ সাদমান নবী জয় বললো, তার কলেজে কোনো অনলাইন ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা ফেইসবুকে ভিডিও দিয়ে দেন।

সবার জন্য সংসদ টিভির বা অনলাইন ক্লাসে ‘উপকার তেমন হচ্ছে না’ সে বলেছে, “স্কুলে টিচারদের কাছ থেকে যে কোনো কিছু বুঝে নিতে পারি। বন্ধুদেরও হেল্প নিতে পারি। অনলাইন ক্লাসে সেটা হয় না।

“আমরা ক্লাস টেনে ওঠার আড়াই মাস পরেই তো স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত- এই সাবজেক্টগুলো তো টিচারদের হেল্প ছাড়া পারা যায় না। শর্ট সিলেবাস যেটা দেওয়া হয়েছে, সেখানে তেমন কিছুই নাই। পাঁচটা করে চ্যাপ্টার নিয়ে ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির সিলেবাস করা হয়েছে। এতে তো আমরা পুরো বইয়ের কিছুই জানব না, অনেক পিছিয়ে গেলাম।”

নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়ায় পড়ালেখা থমকে গেছে জানিয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বললো, “অনলাইনের ক্লাসকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। টিচাররাও দেয় না। আমরা পড়াশুনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের একটা বড় অংশ উচ্চ মাধ্যমিকে আছে। কিন্তু সেটা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেই। ফলে এই বেসিক জিনিসটা জানা না থাকলে আমাদের পরে সমস্যা হবে।”

সমস্যা যে আরও আছে, সে কথা তুলে ধরে তানভীর বললো, “এতদিন পরীক্ষা না দিতে দিতে আমাদের লেখার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। ক্লাস টেনেই পড়াশোনাটা বেশি থাকে। প্রিটেস্ট, টেস্ট দিয়ে ভালোভাবে পড়ে পরীক্ষা দেওয়ার সেই সুবিধাটাতো নাই। প্রস্তুতিই নাই পরীক্ষার, ফলে ক্ষতি তো হয়েই গেল।”

কবে, কীভাবে পরীক্ষা হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ভোগাচ্ছে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ বণিক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী দীপালি রায় দিশাকে।

“পুরো বইটা ভালভাবে শেষ হল না। শর্ট সিলেবাসটা এত সংক্ষিপ্ত যে সেখানে সব টপিক নাই। অনেক কিছুই আমাদের অজানা থেকে যাবে। আমরা আগে যে প্রিপারেশন নিয়েছিলাম, যতটুকু পড়া হয়েছিল, সেগুলো এতোদিনের গ্যাপে ভুলেই গেছি।”

দিশা জানাল, লকডাউন শুরুর পর তার স্কুলের অনলাইন ক্লাসও বন্ধ রয়েছে। স্কুল থেকে পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো দিক-নির্দেশনাও সে পায়নি।

“নিজেদের মত প্রিপারেশন নিচ্ছি যতটুকু পারছি। এই সময়টায় আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অথচ এখন আমরা স্কুলে যেতে পারছি না, তেমন কিছু শিখতেও পারছি না।”

এসবের সাথে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তা।

হলিক্রস কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সুমাইয়া মুনতাহা জানালেন, ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শেষ হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই তাদের কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গতবছর। এরপর দ্বিতীয় বর্ষের পুরোটা সময় কেটেছে বাসায়।

“কিছুই বুঝতেছি না কীভাবে পরীক্ষা হবে, কবে হবে। এখন আমাদের শর্ট সিলেবাস দিয়ে দিল। কিন্তু অ্যাডমিশন টেস্টে কি হবে? সেখানে কী শর্ট সিলেবাসেই পরীক্ষা হবে? অ্যাডমিশন টেস্ট নিয়েও তো কনফিউশনে আছি।”

মুনতাহা জানালেন, তাদের অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকরাও সবকিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতি কমে গেছে।

তার মা নাহিদ ফারহানা চৌধুরী বললেন, সবকিছু নিয়েই অনিশ্চয়তা থাকায় তারা পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত।

“ফার্স্ট ইয়ারে পরীক্ষা হল না। সেকেন্ড ইয়ারে তো বাসাতেই। অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। কিন্তু সায়েন্সের সাবজেক্টগুলো তো হাতে-কলমে না বুঝিয়ে দিলে হয় না। অনলাইনে সবকিছু বোঝানো যায় না, স্টুডেন্টরা বোঝেও না। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ক্লাসের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

“আমরা বাচ্চাদের ঘরে রেখে পড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের পড়াশোনা একেবারে শেষ হয়ে গেল। অনেকে ঝরে পড়বে। অনেকদিন তো ওরা লেখে না, না লিখতে লিখতে লেখাই ভুলে গেছে। কলেজ বন্ধ থাকায় ওদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।”

গুলশান কমার্স কলেজের পরীক্ষার্থী ফাহমিন ইসলাম মুন বলেন, “যে শর্ট সিলেবাসটা আমাদের দিয়েছে, সেটা শেষ হয়ে গেছে। এটা অনেক শর্ট। প্রতি সাবজেক্টের ৪/৫টা অধ্যায় নিয়ে সিলেবাসটা করা। এতে আসলে আমরা তেমন কিছু শিখতে পারব না।”

অনলাইনে ক্লাস চললেও সেখানে মনোযোগ রাখা যায় না জানিয়ে মুন বলেন, “রেগুলার ক্লাস হলে প্রতিদিন হোমওয়ার্ক, ক্লাস ওয়ার্ক হয়, পরীক্ষা হয়। লেখার চর্চাটা থাকে। কিন্তু এতদিন বন্ধ থাকায় সেই অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ বাসায় তো সেভাবে পরীক্ষা দেয়া বা লেখা হয় খুব কম।”

মহামারীতে পড়ালেখায় ভাটা পড়েছে চাঁদপুর সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জাফনুন নাহার পৃথারও।

“লকডাউনে টিউশনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন ক্লাসে তেমন গতি নাই, স্টুডেন্টদের তেমন রেসপন্স নাই। টিচাররাও বিরক্ত হয়ে অনলাইন ক্লাস নেন না। সব সাবেজেক্ট ঠিকমত শেষ হয়নি, রিভিশনও হয়নি। আবার সামনে ভর্তি পরীক্ষা। সবকিছু নিয়েই চিন্তায় আছি।”

পৃথা জানান, এইচএসসি প্রথম বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হলেও তিন বিষয়ের পরীক্ষার পরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে উদ্বিগ্ন পৃথার মা নিলুফা আক্তার বলেন, শিক্ষার্থীরা ঘরে থেকে ‘অতিষ্ঠ’ হয়ে গেছে।

“সবকিছুই অনিশ্চিত। পড়ালেখা তো একেবারে জলে গেল। শুধু আমার মেয়ের না, সবারই একই অবস্থা। ক্লাস আর টিচাদের তাড়া থাকলে ওরা পড়াশুনাটা করে ঠিকমত। এখন তো আর সেটা নাই।

“আর ওরা তো আশায় আছে ওদেরও অটো পাস দিয়ে দিবে। সব মিলিয়ে কিছুই শিখতে পারছে না। ভর্তি পরীক্ষার সময় সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাবে ওরা।”

একই সুরে কথা বললেন নরসিংদীর দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হৃদিকা আক্তারের মা লিপি আক্তার।

“পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে তাই ওরা ভাবছে পরীক্ষাটা হবে কি হবে না। পড়াশোনা করছে না। টিউশনে পড়ত, সেটাও ছেড়ে দিছে। অফুরন্ত সময়, কিন্তু পড়াশোনার চাপ নেই। পরীক্ষার আমেজ নাই।

“পরীক্ষা হবে না এ ব্যাপারটাই তাদের মাথায় ঢুকে গেছে। পরীক্ষা হলেও পরীক্ষা দেবে, কিন্তু শেখাটা হচ্ছে না। ক্লাসও হয়নি তেমন, সে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাও হয়নি।”

পড়াশোনার এই ঘাটতি মেটাতে অনেক অভিভাবকই দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা বলছেন।

ঢাকার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেলের বাবা ফরিদুল ইসলাম বলেন, “অনলাইন ক্লাসে তেমন কোন লাভ হয় না। করোনাভাইরাস ৫ বছর থাকলে ততদিনই ওদের ক্লাস হবে না? স্বাস্থ্যবিধি মেনে ২০ জন করে শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস করাক টিচাররা। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখায় ওরা আজীবনের জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।”

মনিপুর স্কুল ও কলেজের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বিরের বাবা নুরূল ইসলাম মনির বলেন, “স্বাভাবিক পড়াশোর বাইরে ওরা। যতটুকু পারছে করছে। কিন্তু চাপও দিতে পারছি না। টিচার রেখেছি পড়াশোনাটা চলমান রাখার জন্য।

“আমার মনে হয় সপ্তাহে দুই দিন করে হলেও পরীক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া উচিত। ওদের বড় একটা গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে। এই গ্যাপটা নিয়েই বাকী জীবনটা ওদের পার করতে হবে।”

Share this news