খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরতে কিশোর ছেলেটির আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফেরা-এ যেন প্রতিটি বাড়ির চিরাচরিত নিয়ম। দুরুদুরু বুকে দরজায় পা রাখতেই মায়ের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে এলো, এটা কি ‘মগের মুল্লুক’ পেয়েছো যে যা খুশী তাই করবে? সন্ধ্যা হয়েছে কখন সে খেয়াল কি আছে!
গল্প, আড্ডা, আলোচনা বা কথাচ্ছলে প্রবাদের ব্যবহার চিরাচরিত। কতগুলো শব্দ বা একটি বাক্য দিয়ে অল্প কথায় অনেক কিছু বোঝানো যায় প্রবাদের মাধ্যমে। জীবনপথে চলার অনেক উপদেশের আধার এই প্রবাদ।
একেকটি প্রবাদের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কোনো একটি জাতি বা গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কোনো অভিজ্ঞতা বা ঘটনা। সেটা হতে পারে তিক্ত বা আনন্দময়। মানুষের মুখে মুখেই প্রবাদের উদ্ভব এবং লোকসাহিত্যের অঙ্গ হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর প্রচলন চলে আসছে।
কোনো অনিয়ম, অরাজকতা বা অন্যায়ভাবে অত্যাচারের ঘটনাগুলো দেখলে বা এ নিয়ে কথা বলতে গেলে মগের মুল্লুক এই প্রবাদটির বেশ প্রচলন রয়েছে। এই প্রবাদটির সৃষ্টির পেছনে রয়েছে ইতিহাসের এক তিক্ত অধ্যায়।
ষোড়শ শতাব্দীর কথা। বাংলার শাসন ভার তখন মুঘল শাসকদের হাতে। যুগে যুগেই প্রতিটি শাসনামলেভালো কাজ এবং সুশাসকের কথা যেমন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে ঠিক তেমনি কিছু দুষ্ট মানুষ এবং তাদের কর্মযজ্ঞও কালো অধ্যায়ের অংশ হয়ে উঠেছে।
পূর্ববঙ্গ বিশেষত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অর্থাৎ চট্টগ্রামে হঠাৎ করে জলদস্যুদের উপদ্রব শুরু হয়। এরা মগ জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। এই জলদস্যুরা ছিল আরাকান দেশের অধিবাসী বর্তমানে যা মায়ানমার নামে স্বীকৃত।পর্তুগীজ নৌ-দস্যুদের একটি বিশেষ বাহিনী এই মগ জলদস্যুরা। নৌপথে যুদ্ধ কৌশলে তারা বিশেষ পারদর্শী।
বঙ্গভূমি তখন ধন-ধান্যে বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল। আর চট্টগ্রাম ছিল প্রধান সমুদ্রবন্দর তাই এই এলাকায় জনসাধারণের বসতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও এক গমগমে মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল। হয়তো এ কারণেই মগ দলদস্যুরা তাদের অরাজক কর্মকান্ডের জন্য বাংলার এই অংশটিকে বেছে নিয়েছিল।
বিভিন্ন নদী এবং সমুদ্রে জলযানেই ছিল এদের বসবাস। পরিবার নিয়ে অনেকটা যাযাবরের মতো জলের এ সীমানায় সে সীমানায় ভেসে বেড়াতো তারা।
তাদের অত্যাচার আর উপদ্রবের মাত্রা এতোই বেশি ছিল যে শোনা যায় সেইসময় চট্টগ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। তবে কেবল চট্টগ্রাম নয় পুরো বাংলা এবং আসাম জুড়ে পুরো ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।
মগ সম্প্রদায় এবং মগ শব্দ, এ দুইই বাংলার মানুষের কাছে চরম ঘৃণ্য হয়ে উঠে। স্বেচ্ছাচারীতা, অত্যাচার, লুটপাট, নির্যাতন, ডাকাতি, অপহরণ-এক কথায় বিভীষিকাময় তান্ডবলীলায় মত্ত হয়ে উঠে এই মগ জলদস্যুরা।
একবার এদের কবলে পড়লে আর রক্ষা নেই। মানবপাচারকারী হিসেবেও কুখ্যাতি পেয়েছিল। বাংলার মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশে বিক্রি করে দিতো।
ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠে।
মগ জলদস্যুরা যাদের বন্দী বানিয়ে রাখতো তাদের হাত-পা ফুটো করে ফেলে রাখতো যাতে তারা কোনোভাবে পালিয়ে না যেতে পারে। আর খাবার হিসেবে বন্দীদের সামনে কিছু শুকনো চাল ছিটিয়ে দেওয়া হতো।
ভরা সংসারের একজন গৃহস্থের সবটুকু কেড়ে নিয়ে মূহুর্তেই ক্রীতদাসে পরিণত করতো এই মগেরা। অন্যায় করা যেনো এই দুষ্ট মানুষগুলোর নেশা আর পেশায় পরিণত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ‘রুখবে আমায় কে?’ আর এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মন শুধিয়ে বসে, বাংলার শাসক থাকা সত্ত্বেও এমন দুষ্ট লোকেদের দৌরাত্ম্য এতোটা বেড়ে গিয়েছিল কীভাবে?
মগের জলদস্যুরা নৌযুদ্ধে বিশেষভাবে সিদ্ধহস্ত ছিল। আর পর্তুগীজদের ছত্রছায়ায় যেনো শাণিত তলোয়ার হয়ে উঠেছিল। আর এটাই ছিল সেসময়ের মুঘল শাসকদের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। কারণ তারা পানিপথের যুদ্ধে তখনও সেভাবে অভ্যস্ত বা পারদর্শী হয়ে উঠে নি। ফলে মগেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছিল।
কথিত আছে, মগেদের অত্যাচারের সাথে ঠিক পেরে না উঠে খান-ই-দুরান নামের এক মুঘল সুবেদার তার রাজ্যপাট ছেড়ে রাজমহল পালিয়ে যান।
বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনী এবং গীতিকাব্যেও মগেদের অত্যাচার আর হিংস্রতা সম্পর্কে লেখা হয়েছে। যা পড়লে আজো গায়ে কাঁটা দেয়।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, প্রায় দুইশোবছর ধরে মগেরা বাংলার মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল এবং শায়েস্তা খানের আমলে এসে অবশেষে এই দুষ্ট শক্তির পরাজয় ঘটে।
মগেরা বিলীন হয়েছে সেই কবে, কিন্তু ইতিহাস তাদের কুকর্মের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে। তাই আজো কোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বা স্বেচ্ছাচারীতা ঘটতে দেখলে সময়ের বর্ণনায় বা ভুলের নির্দেশ করতে বলা হয় এ যেন ‘মগের মুল্লুক’।
শবনম জাবীন চৌধুরী ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।