Published :
Updated :
ভর্তা বাঙালির কাছে অত্যন্ত পরিচিত এক নাম। শুধু বাঙালি বললে ভুল হবে, মোটা দাগে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই ভর্তার চল রয়েছে। অঞ্চলভেদে এই ভর্তা বাটা, ‘ভাতে’, ‘চোখা’ ইত্যাদি নামেও পরিচিত। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, অত্যন্ত মুখরোচক এই ভর্তার জনপ্রিয়তার কমতি নেই কোথাও। সময়ের সাথে সাথে কীভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের খাদ্যতালিকার নিয়মিত অংশ হয়ে উঠলো ভর্তা, সে ইতিহাসও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়।
বাংলা ভর্তা বা ভরতা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে। একই বানানে আরো একটি শব্দের অর্থ ভরণপোষণকারী বা স্বামী হলেও, খাদ্য হিসেবে পরিচিত ভর্তার প্রচলিত অর্থ সিদ্ধ অথবা ভাজা সবজি থেকে পিষে তৈরি করা এক ধরনের খাবার। শুরুটা সবজি থেকে হলেও, সময়ের পরিক্রমায় ভর্তায় যুক্ত হয়েছে অভিনবত্ব। শুধু সবজিই নয়, ভর্তা হয় মাছেরও এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাংসকেও ভর্তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।
বাংলাভাষীদের কাছে ভর্তার সংজ্ঞায়নের প্রয়োজনীয়তা নেই। গবেষকদের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ১০০’র মতো শাক-সবজি এবং পাঁচ শতাধিক মাছ পাওয়া যায়। এই সবজি বা মাছের সাথে যুক্ত হয় কাঁচা মরিচ অথবা শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ কুচি এবং সরিষার তেল। যুক্ত হতে পারে ধনিয়াপাতা কুচি, রসুনও।
আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই রসুন এবং পেঁয়াজের পরিবর্তে যোগ করেন কোরানো নারিকেল। অঞ্চলভেদে ভর্তায় পোস্তর উপস্থিতিও চোখে পড়ে।
ভর্তার উদ্ভব ঠিক কবে হয়েছিল, সে কথা বলা দুষ্কর। চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃত পৈঙ্গলে যে খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেখানে গরম ভাতে ঘি, কলাপাতার ভেতর রান্না করা মৌরলা মাছ, নালিতা বা পাটশাক বাটার উল্লেখ রয়েছে। এমনকী মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও দেখা যায়, বাথুয়া শাক ও আদা ছেচে নিয়ে একধরনের পদ প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরাসরি এদেরকে ভর্তার পূর্বসূরী বলে দাবী করা না গেলেও প্রস্তুতপ্রণালী অনুযায়ী এরা যে ভর্তারই সমগোত্রীয়, তা বলা যেতেই পারে।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস গবেষকদের কারো কারো মতে, ভর্তার জন্ম এ অঞ্চলের মুসলমানদের রান্নাঘরে। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় পেঁয়াজ রসুনের ব্যবহারকে। তবে, যে ধর্মাবলম্বী মানুষই ভর্তার প্রচলন করে থাকুন না কেন, একটা কথা সকলেই এক বাক্যে মেনে নেন যে ভর্তা ব্রাত্যজনতার হেঁসেল থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বত্র।
গাজীপুরের হোটেল নিরিবিলি প্রতিদিন পরিবেশন করে অন্তত ৭০ ধরণের ভর্তা
ভর্তার প্রস্তুতিতে কখনোই অতিরিক্ত মশলা ব্যবহার হতো না। পেঁয়াজ-মরিচের বাড়তি ব্যবহারের কারণে ভর্তা একদিকে যেমন হয়ে উঠতো মুখরোচক, তেমনি অল্প পরিমাণ ভর্তা দিয়েই খাওয়া যেতো অনেকটা ভাত। হাতের কাছে পাওয়া শাকপাতা, সবজি কিংবা মাছের সাথে মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল পিষে নিলেই হয়ে যায় খাদ্যের জোগাড়।
সিদ্ধ করা, পুড়িয়ে নেয়া বা সামান্য ভেজে নিয়ে ভর্তার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া এইসব শাক-সবজি নিরামিষাশীদের মাঝেও সহজেই জায়গা করে নেয়। অর্থাৎ, সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এবং সাশ্রয়ী হিসেবেই ভর্তার ছিল স্বাতন্ত্র্য। এজন্য সাধারণ মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই ধীরে ধীরে ভর্তার প্রচলন হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নায়।
ভর্তা আদিকালে শুধু সাধারণের খাদ্যতালিকায় থাকলেও সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের খাদ্যের অংশ হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবী করেন গবেষকরা। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী সংকটের মধ্যে মানুষকে নির্ভর করতে হতো চাষাবাদ ছাড়াই প্রাপ্ত ফসলের ওপর। বিভিন্ন সবজি ও সবজির খোসা থেকেও যে ভর্তা তৈরি করা সম্ভব এমন ধারণা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে।
এছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশে একদিকে মুসলিম অধ্যুষিত সংস্কৃতি, অপরদিকে খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বাঙালিয়ানা – এ দু’য়ের মিশেল ভর্তাকে দিয়েছে জাতীয়ভাবেই জনপ্রিয়তা। শুধু প্রান্তিক জনতার কুঁড়েঘরেই আজ আটকে নেই ভর্তা। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে এদেশের উচ্চবিত্তের খাদ্যেরও এক নিয়মিত অংশ বিভিন্ন ধরণের ভর্তা। এমনকী হোটেল-রেঁস্তোরাতেও ভর্তার আছে আলাদা কদর।
আজকাল ভর্তার বাফেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে
মূলত ১৯৭০ এর দশক থেকেই ভর্তা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভর্তা তৈরির প্রতিযোগিতামূলক রিয়েলিটি শোও হতে দেখা যায়।
নতুন আঙ্গিকে সাজানো হচ্ছে ভর্তাকে। এর ফিউশন সৃষ্টি করা হচ্ছে অন্যান্য দেশের রন্ধনপ্রণালীর সাথে। বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরেও প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে ভর্তার উৎসব হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। কয়েক পদের ভর্তা ছাড়া বর্তমানে পহেলা বৈশাখের উদযাপন চিন্তাই করা যায়না।
সময়ের সাথে সাথে ভাতের ওপর ভাঁপে সিদ্ধ করা সবজি হয়তো জায়গা করে নেবে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে, কিন্তু বাঙালির রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে ভর্তা তার দ্যুতি ছড়াবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যয়নরত।
sherajularifin@iut-dhaka.edu