মীরা নায়েরের মনসুন ওয়েডিং: পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, রক্ষণশীলতা এবং পরিবর্তনের গল্প
Published :
Updated :
“দিস ইজ নট অ্যানি ওয়েডিং, দিস ইজ আ পাঞ্জাবি ওয়েডিং- এটি যেকোনো সাধারণ বিয়ে নয়, এটি এক পাঞ্জাবিদের বিয়ে।" উৎসবের চাকচিক্য বোঝাতেই ললিত বর্মা কথাটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আসরে। দিল্লীতে বেড়ে ওঠা এক পাঞ্জাবি পরিবারের কন্যার বিয়ের আসরকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সিনেমার গল্প।
চিরায়িত ভারতীয় চলচ্চিত্রকে চ্যালেঞ্জ করেই মীরা নায়ের পরিচালিত মনসুন ওয়েডিং চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০০১ সালে। মুক্তির পরপরই চলচ্চিত্রটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হতে থাকে।
মীরা নায়েরের ক্যামেরার সুনিপুণ কাজে শুধু একটি বিয়ে বাড়িই উপলক্ষ হয়ে ওঠেনি বরং গল্পের সমান্তরালে চলেছে ভারতবর্ষের প্রচলিত পারিবারিক সম্পর্কের গভীরতা, চলমান সমাজের ভেতরকার সম্পর্কের বাঁকবদল, প্রজন্মান্তরের সংঘাত এবং হৃদয়ের লুকানো অনুচ্চারিত অনুভূতির নানান চড়াই-উৎরাই।
পুরো চলচ্চিত্রটির অন্যতম বিশেষত্ব এর গল্পের স্বাভাবিকতা, যেন পরিবারটি আমাদের বহু আগের চেনা। এমনকি যেন বাড়িটির বাগানে আমরা বসে চা খেতেও বসেছি কোনো একদিন। চলচ্চিত্রটি জুড়ে কখনও মনে হবে না কোথাও ক্লান্তির ছাপ, বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র মুহূর্ত ধরা দিয়েছে স্বমহিমায়।
বর্মা পরিবার মেতে ওঠেছে এক জাঁকজমকপূর্ণ ব্যয়বহুল বিয়ের আয়োজনে।
মেয়ে অদিতির বিয়ে নিয়ে বাবা ললিত বর্মা ভীষণরকম ব্যস্ত। অতিথি তালিকা, ঘর সাজানো, খাবার-দাবার সবকিছুই যেন একা হাতে দেখভাল করছেন তিনি।
বিয়েতে পরিবারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন এক জায়গায় আসে যা ভারতীয় সংস্কৃতির চিরচেনা রূপ। পাত্র পুরনো বন্ধুর ছেলে হেমন্ত।
অসাধারণ বাকপটুতা, নম্র, ভদ্র এবং ভীষণরকম অমায়িক সাথে আমেরিকায় বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। সব মেয়ের বাবার কাছেই আদর্শ পাত্র যাকে বলে। বিয়ের উৎসব চলতে থাকে। কিন্তু তখনও আদিতির মধ্যে রয়ে গিয়েছে অতীত প্রেমের অনুরণন। মানবমনের গভীরে চলা প্রবল দ্বান্দ্বিকতা যেন ফুটে ওঠে গল্পের মাঝে।
গল্পের সমান্তরালে আরেক চরিত্র মূখ্য হয়ে ওঠে রিয়া। ছোটবেলায় বাবা হারানো রিয়া বড় হতে থাকে বর্মা পরিবারেই। বড় চাচার থেকে নিয়মিত যৌন নিপীড়নের শিকার রিয়ার মনে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়, তার শেকল ভেঙ্গে দেয় যখন পুনরায় এমন কিছু হবার সম্ভাবনা সে আঁচ করতে পারে। পর্দার আড়ালে সাজানো সমাজব্যবস্থায় গভীর ফাটল ধরে, উম্মেচিত হয় সমাজের সাজানো মুখোশ। রিয়া হয়ে ওঠে গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র যার প্রতিবাদ কোনো স্লোগান নয় বরং নীরবতার ভেতর জন্ম নেয়া সাহস।
ললিত বর্মা চরিত্রে নাসিরুদ্দীন শাহ মূলত পিতৃতন্ত্রের এক প্রতিচ্ছবি। একদিকে গতানুগতিক পারিবারিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি অন্যদিকে বাবার চরিত্রকে পাশ কাটিয়ে মানবিকতা ও ন্যায় যাঁর কাছে মূখ্য।
চলচ্চিত্রটির নৈতিক শিক্ষারদানকারী চরিত্রটিকে শক্তিশালী করে। গল্পের অন্য একটি চরিত্র তেজ যেন ভারতীয় পরিবারের এক গভীর অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি। পাশাপাশি পারিবারিক রক্ষণশীলতা, দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এবং পরিবারের অন্ধকার দিকটিও ফুটে ওঠে গভীরভাবে।
গল্পের বাঁকবদলে দুবে ও আলিসের প্রেমও দারুণ বার্তা দেয়। সামাজিক অবস্থানের অনেক উর্ধ্বে যে প্রেম-ভালোবাসা, সেটারও শক্তিশালী বার্তা বহন করে এই সিনেমা।
নিঁচু শ্রেণী এবং উচ্চবিত্তের ভেদরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানুষই ওয়েডিং প্ল্যানার দুবে ও গৃহকর্মী আলিস, যাঁদের প্রেম যেন নিখাদ বৃষ্টিবিন্দুর মতো-নীরব, নির্মল এবং আবেগময়। দুবের সরল প্রেম আর আলিসের লাজুক দৃষ্টি, এই সিনেমায় “অভ্যন্তরীণ ভারতবর্ষ” কেই যেন উপস্থাপন করে।
পুরো সিনেমাতে বর্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্ষা নিজেও যেন হয়ে ওঠে মূলচরিত্র।
বর্ষা যেন নিয়ে আসে শুদ্ধতা, আবেগের বহিঃপ্রকাশ ও নতুন জীবনের সূচনার অনুঘটক।
সিনেমাজুড়ে বিভিন্ন রং(কমলা, লাল, নীল) এর ব্যবহার যেন প্রতিটি চরিত্রকে দৃশ্যগত রূপ দেয়। শৈল্পিকতা এবং নান্দনিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
অসাধারণ এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য মূলত একটি ডকুড্রামা, শেফালি শাহ অভিনীত রিয়া চরিত্রটি মূল একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া চরিত্র। এইচ বি ওতে প্রথম কোনো ভারতীয় সিনেমা হিসেবে প্রচারিত হয় মনসুন ওয়েডিং। ২০০১ সালে ৪৩ বছর পর ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিবলে গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয় এই সিনেমা। মাত্র ৩ কোটি রুপিতে নির্মিত চলচ্চিত্রটি আয় করে ২০০ কোটি রুপিরও বেশি।
mashuilbasher@gmail.com