Bangla
3 months ago

মুড়ি মাখায় জিলাপি: স্বাদের বৈচিত্র্য নাকি পুষ্টির বিপর্যয়?

জিলাপি ও মুড়ি - প্রতীকী ছবি
জিলাপি ও মুড়ি - প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

রমজান মাসের ইফতার মানেই ভাজাপোড়া আর বাহারি খাবার। বিকেল হতেই আজানের ধ্বনি, ফুটন্ত তেলে মচমচে পেঁয়াজু-বেগুনি ভাজার ঘ্রাণ, এবং রাস্তার ধারের দোকান থেকে ভেসে আসা 'ভাই, গরম জিলাপি'র ডাক—সব মিলিয়ে ইফতার কেবল খাবারের আয়োজন নয়, বরং এক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব ও বটে।

গত কয়েক বছর ধরে ইফতারে 'বাঙ্গি নাকি তরমুজ' নিয়ে বিবাদমান জাতি এই বছর খুঁজে পেয়েছে নতুন বিষয়। জাতি এবার বিভক্ত মুড়ি মাখানোয় জিলাপি থাকবে নাকি থাকবে না, তাই নিয়ে।

বাঙালির ইফতারের টেবিলে মুড়ি মাখার উপস্থিতি অবধারিত।

সরিষার তেল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ছোলা ও লবণের সংমিশ্রণে তৈরি এই অনন্য স্বাদের আইটেমটি প্রায় প্রতিটি ইফতার টেবিলেই থাকে। শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং সহজপাচ্যতা ও পুষ্টিগুণের কারণেও মুড়ি মাখা জনপ্রিয়।

মুড়ি—হালকা, কম ক্যালোরিযুক্ত এবং সহজেই হজমযোগ্য একটি খাদ্য, যা দীর্ঘসময় না খাওয়ার পর শরীরকে ধীরে ধীরে খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। তবে, বিতর্কের সূত্রপাত হয় তখনই, যখন কেউ মুড়ি মাখার মধ্যে জিলাপি মেশানোর সিদ্ধান্ত নেন। 

কেউ বলেন, এটি স্বাদের বৈচিত্র্য, আবার কেউ বলেন, 'মুড়ি মাখায় জিলাপি? এটা তো রীতিমতো খাবারের অপমান!' এ নিয়ে তর্ক যেন শেষই হয় না!

কিন্তু আসলে এটা কি শুধু স্বাদের বিষয়, নাকি পুষ্টি ভারসাম্য সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারও জড়িত?

মুড়ির মূল উপাদান চাল, যা কার্বোহাইড্রেটের চমৎকার উৎস। এটি স্বল্পমাত্রার ফাইবার এবং প্রোটিনযুক্ত হলেও উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন খাবার।

যা দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ায়। তবে মুড়ি একা খেলে এতে প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থেকে যায়, তাই ইফতারের সময় মুড়ির সঙ্গে ছোলা, শসা, টমেটো, সরিষার তেল, কাঁচা মরিচ মিশিয়ে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। 

জিলাপি মূলত রিফাইন্ড আটা ও চিনির সংমিশ্রণে তৈরি, যা উচ্চমাত্রার ক্যালোরিযুক্ত। একটি মাঝারি আকারের জিলাপিতে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ক্যালোরি থাকে, যার বেশিরভাগই চিনি ও ট্রান্স ফ্যাট থেকে আসে।

রমজানের দীর্ঘ উপবাসের পর অতিরিক্ত চিনি শরীরে তাৎক্ষণিক এনার্জি দিলেও এটি দ্রুত ইনসুলিন বৃদ্ধি ঘটায়, যা বিপাকক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দীর্ঘ উপবাসের পর উচ্চমাত্রার মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া ইনসুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যা টাইপ-টু ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে । এছাড়া জিলাপির ট্রান্স ফ্যাট হৃদরোগের জন্যও ক্ষতিকর।

ঝাল-মশলা মাখানো মুড়ি এবং অতিরিক্ত মিষ্টি জিলাপি একসঙ্গে খেলে এক ধরনের মিষ্টি ও লবণের সংমিশ্রণ তৈরি হয়, সল্টেড ক্যারামেল বা মধু-চিজের মতো বিপরীত স্বাদের মিশ্রণ যা অনেকের কাছে দারুণ লাগে। তবে এটি শরীরের জন্য কতটা ভালো?

পুষ্টিগত দিক বিবেচনায় এটি খুব একটা ভালো খাবার না। কারণ, জিলাপি ও মুড়ি মাখা একসঙ্গে খেলে শরীর মাত্রাতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ করে, যা স্থুলতা ও ইনসুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি কার্বোহাইড্রেট ও চিনির উচ্চমাত্রার উৎস, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়ায়। 

পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলেন, রোজার পর কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো, যা দীর্ঘ সময় শক্তি ধরে রাখে। কিন্তু জিলাপি রিফাইন্ড চিনি ও ময়দার তৈরি, যা রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয় এবং পরে হঠাৎ কমিয়ে ফেলে, ফলে দ্রুত ক্লান্তি আসে। ১টি মাঝারি জিলাপিতে ১৫-২০ গ্রাম চিনি থাকে, যা বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার সুপারিশকৃত দৈনিক সীমার প্রায় অর্ধেক।

জিলাপি ডিপ-ফ্রাই করা হয়, এতে ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। জিলাপির সহজপাচ্য চিনি দ্রুত ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়, যেখানে ছোলা বা ডিম দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে।

পুষ্টিগত তুলনার হিসেবে সাধারণ মুড়ি মাখা বনাম জিলাপি যুক্ত মুড়ি মাখা

মুড়ি মাখায় জিলাপি যোগ করলে চিনি, ক্যালোরি ও ফ্যাট বাড়ে, কিন্তু প্রোটিন ও ফাইবার কমে যায়, যা খাবারের পুষ্টি মান কমিয়ে দেয়। সাধারণ মুড়ি মাখায় মাত্র দুই গ্রাম চিনি থাকে, যেখানে জিলাপি যোগ করলে তা ২০ গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা শরীরে দ্রুত গ্লুকোজ বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রোটিনের দিক থেকে দেখলে সাধারণ মুড়ি মাখায় পাঁচ গ্রাম প্রোটিন থাকে, যা শরীরের জন্য উপকারী। তবে জিলাপি মেশালে এই পরিমাণ কমে তিন গ্রাম হয়ে যায়, কারণ, জিলাপি নিজেই কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ একটি খাবার, এতে প্রোটিন থাকে না বললেই চলে।

ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণও পরিবর্তন হয়। সাধারণ মুড়ি মাখায় ছয় গ্রাম ফ্যাট থাকে, যেখানে জিলাপি মেশালে এটি দ্বিগুণ হয়ে ১২ গ্রাম হয়ে যায়, কারণ জিলাপি ডুবো তেলে ভাজা হয় এবং এতে অতিরিক্ত চিনি থাকে।

ফাইবার বা আঁশের দিক থেকেও পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। সাধারণ মুড়ি মাখায় তিন গ্রাম ফাইবার থাকে, যা হজমের জন্য ভালো। কিন্তু জিলাপি যোগ করলে তা কমে এক গ্রাম হয়ে যায়, কারণ, জিলাপিতে কোনো ফাইবার থাকে না।

এভাবে পুষ্টি মানের হিসেবটা দেখলে, জিলাপি ছাড়া মুড়ি মাখা তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর ও কম ক্যালোরিযুক্ত, যেখানে জিলাপি যোগ করলে এটি বেশি চর্বি, চিনি ও ক্যালোরিযুক্ত হয়ে যায়। তাই যারা কম ক্যালোরি ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চান, তাদের সাধারণ মুড়ি মাখাকে বেছে নেয়াই ভালো। 

তাহলে কি মুড়ি মাখায় জিলাপি একেবারেই দেয়া যাবে না ? যদি আপনি জিলাপিপ্রেমী হন, তবে মাঝে মধ্যে খেতে পারেন—কিন্তু নিয়মিত নয়। তবে মুড়ি মাখার স্বাদ বাড়াতে জিলাপির পরিবর্তে কিছু স্বাস্থ্যকর বিকল্প ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

জিলাপির মিষ্টি স্বাদের বদলে টকদই মিশিয়ে দেখুন! এটি মুড়িকে নরম না করেই ক্রিমি টেক্সচার দেবে, পাশাপাশি হজমেও সহায়ক হবে।

বাদাম বা চিড়া ভাজা মেশাতে পারেন। এতে মুচমুচে ভাব বাড়াবে, পুষ্টিও বাড়বে।

আপনার মিষ্টি ও লবণের ফিউশন খুব বেশি পছন্দের হলে জিলাপির পরিবর্তে প্রাকৃতিক মিষ্টি হিসেবে খেজুর ও বাদাম মেশাতে পারেন, এতে স্বাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে ফাইবারের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাবে

মুড়ি মাখায় জিলাপির পক্ষে বা বিপক্ষে- যে যেই দলে থাকুন না কেন, রমজানের ইফতার আসলে একতা, ভাগাভাগি ও একসঙ্গে উপভোগ করার সময়।

স্বাদের দিক থেকে ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার, তবে পুষ্টির দিক থেকে জিলাপি দিয়ে মুড়ি মাখা স্বাস্থ্যকর নয়। এটি অতিরিক্ত ক্যালোরি, চিনি ও ফ্যাট বাড়ায়। তারপরেও যদি খেতেই হয়, তবে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। 

তবে, কাউকে না জানিয়ে তার মুড়ির মধ্যে জিলাপি মেশানো হতে পারে বিপজ্জনক! কারণ, খাবার নিয়ে বিতর্ক হয়তো ঠেকানো যাবে না, তবে খাবার নিয়ে লড়াই এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়!

jarinrafa20@gmail.com

Share this news