Published :
Updated :
গতকাল সোমবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সংবাদ শিরোনাম দেখে সেটাতে চোখ আটকে গেল। সেটা হলো ‘অবশেষে মিলল শেখ হাসিনার পদত্যাগের চিঠি’। সংবাদে প্রবেশ করার পর দেখা গেলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরযুক্ত একটি পদত্যাগ পত্র। যেটা রীতিমতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
সাড়ে ১৫ বছর বিভিন্ন সমালোচনার মুখে দেশ পরিচালনার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি সে দেশেই অবস্থান করছেন। তাহলে পালিয়ে যাওয়ার ৪০ দিনের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর এই পদত্যাগপত্র ফাঁস হওয়ার মাহাত্ম্য কি হতে পারে? এটার কি আদৌ কোনো গুরুত্ব রয়েছে? সে সম্পর্কে বলার আগে তার প্রেক্ষাপটটা একটু বর্ণনা করি।
ভারতে অবস্থানরত অবস্থায় জনৈক তানভীর কায়সারের সাথে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফাঁস হয়। সে কথোপকথনের এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তিনি নাকি পদত্যাগ করে নি। সংবিধানের ধারা মোতাবেক তিনি পদত্যাগ না করায় সাংবিধানিকভাবে তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পদত্যাগ করে থাকলে পদত্যাগপত্রটা প্রকাশ করা যেত- এধরণের কথাও শেখ হাসিনার কণ্ঠে শোনা যায়। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘দেশের আশেপাশেই আছি। যে কোনো মূহুর্তে চট করে দেশে ঢুকে যেতে পারি।’
তাছাড়া. শেখ হাসিনা আদৌ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কি না- সে নিয়ে নাগরিক সমাজের কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এ পরিস্থিতিতে কারো কারো মধ্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে মৃদু ধোঁয়াশা পরিলিক্ষিত হয়। আর এই প্রেক্ষাপটেই সামনে এলো পদত্যাগপত্রটি।
এ পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া পদত্যাগপত্রটি সঠিক না ভুয়া এটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন পদত্যাগপত্রটি সঠিক এবং এটি বিভিন্ন গুজবকে প্রতিরোধ করবে। আবার কেউ কেউ বলছেন পদত্যাগপত্রটি ভুয়া এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগ করেন নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ থেকে ভাইরাল সেই পত্রটিকে ‘ভুয়া’ বলে দাবি করা হয়েছে।
দেশের অন্যতম ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার ফেসবুকে ভাইরাল এই পদত্যাগপত্রটি ভুয়া বলে জানিয়েছে। সেটাতে বাংলা বছরের তারিখও ভুল দেওয়া আছে।
দেশের ইতিহাসে তীব্রতম আন্দোলনের মুখে কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রায় সব জনপ্রতিনিধি পালিয়ে যাওয়ার ৪০ দিন পর, কোনো আন্দোলন ছাড়াই সমাধান করা যায়- এমন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর, পর পর তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পর কি শেখ হাসিনার পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা সঠিকভাবে হয়েছে কি না- সেটা নিয়ে কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার কোনো অবকাশ রয়েছে? নিঃসংকোচে এর উত্তরে বলা যায়, না।
৫ আগস্ট দিবাগত রাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের সাথে নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট করেই বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি সেটা গ্রহণ করেছেন।
সংবিধানের ৫৭ ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার জন্য যে শর্তাবলী আছে সেগুলোর মধ্যে দুটি হলো রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগ জমা দেওয়া আর সংসদ সদস্য পদে না থাকা। রাষ্ট্রপতির ঘোষণা অনুযায়ী তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং এর পরের দিন তিনি দ্বাদশ সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছেন। তারপর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের ভিত্তিতে মতামতও নেয়া হয়েছে।
সুতরাং এ মহুর্তে শেখ হাসিনার পরিচয় তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সে জন্য প্রকাশিত পদত্যাগপত্র সঠিক না ভুয়া এমন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের পেছনে সময় নষ্ট না করে সবার, বিশেষ করে গণমাধ্যমের উচিত অন্তবর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে সহযোগিতা করার মাধ্যমে শুধু পরবর্তী নির্বাচন নয়, আগামী প্রতিটি নির্বাচনে দেশের ক্ষমতার পালাবদলকে আনন্দময় করে তুলতে ভূমিকা রাখা।
মনে রাখতে হবে, লাখো শহীদের রক্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই ৫৩ বছরে ক্ষমতা ধরে রাখার এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার চক্রান্তে-পাল্টা চক্রান্তে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দুইজন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন। তাঁরা ছাড়াও এই চক্রান্তে কত মানুষের প্রাণ গেছে সেটা গণনা করে শেষ করা যাবে না। সবশেষে, যেটা আগেই বললাম, কোনো আন্দোলন ছাড়াই সমাধান করা যায়- এমন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের মৃত্যু দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
এমন রক্তাক্ত অতীতের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে- এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: সাংবাদিক