Bangla
2 years ago

অওকিগহারা: আত্মহত্যার বন

ছবি: সিএনএন
ছবি: সিএনএন

Published :

Updated :

‘আপনার জীবন আপনার বাবা-মায়ের দেওয়া একটি মূল্যবান উপহার’

জাপানের একটি বনের প্রবেশদ্বারে এই কথাগুলো বেশ স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে। সবুজ ও মনোরম একটি বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুটা সময় কাটাতে এসে শুরুর পথেই এমন একটা লেখা কেমন যেন একটি অস্বস্তিদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করে।

সে যাই হোক, বিষয়টিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জালের মতো এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে থাকা গাছের শিকড় পেরোতে পেরোতে হঠাৎই যদি চোখের সামনে গাছ থেকে ঝুলন্ত কোনো লাশ বা মাটিতে লুটিয়ে থাকা নিথর দেহখানার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে, তবে অনুভূতিটা ঠিক কেমন হবে? 

শত শত বছরের পুরনো বৃক্ষের সারি বুকে ধারণ করে আগলে রেখেছে জাপানের অওকিগহারা নামের একটি বন। জাপানিজ ন্যাশনাল ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১,২০০ বছর আগে ফুজি পর্বতের আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভার উপর ধীরে ধীরে জমা হওয়া মাটির আস্তরণের উপর এই বন তৈরি হয়েছে। এই বনটি ‘সি অব ট্রিজ’ নামেও পরিচিত। 

তবে ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ বা ‘আত্মহত্যার বন’ এই পরিচিতিটি বাকি সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে। জাপানের রাজধানী টোকিও শহর থেকে ঘন্টা দুয়েকের পথ পেরুলেই দেখা মিলবে এই আত্মহত্যার বনের।

বিশ্বের ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার জন্য পরিচিত হিসেবে সুইসাইড ফরেস্টের অবস্থান দ্বিতীয় আর প্রথম স্থানে রয়েছে গোল্ডেন গেট ব্রীজ।

প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা এই বনের পরিবেশ খানিকটা ভৌতিক বললে ভুল বলা হবে না। গাছগুলো ঠিক সোজা নয় কেমন এঁকেবেঁকে উঠে গেছে আবার কিছু যেনো ঘাড় বাঁকিয়ে নুইয়ে রয়েছে। গাছগুলো এতো ঘন দেখলে মনে হয় যেনো গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুরো বন জুড়ে গাছের শিকড়গুলো জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে। বনটি একদম পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ার কারণে এটা অনেকটা পাথুরে, এবড়োথেবড়ো এবং শত শত গুহা রয়েছে।

এই বনে জন্তু জানোয়ারও বিশেষ একটা দেখা যায় না। সবমিলিয়ে কেমন একটা থমথমে, স্থিরভাব। এখানে নিঃশ্বাস ফেললে তা প্রতিধ্বনি হয়ে অনেকটা গর্জনের মতো শোনায়।

লাভার আস্তর থাকার কারণে এখানে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেটিক আয়রন রয়েছে ফলে আধুনিক সব প্রযুক্তি এবং যন্ত্র যেমন কম্পাস বা মোবাইল, কিছুই কাজ করে না এখানে। কম্পাস রীতিমত অদ্ভুত আচরণ করে বসে আর উল্টাপাল্টা দিকনির্দেশ করে। 

১৯৫০ সালের শুরুর দিক থেকে সেখানে গমনরত পর্যটকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পঁচাগলা লাশের কথা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানান। লাশগুলো সেখানে কীভাবে এসেছিল বা তাদের ভাগ্যে কী জুটেছিল তা আজও এক রহস্য।

১৯৬০ সালের দিকে সেইচো মাতসুমোতো তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘কুরাই জুকাইয়ে’ উপন্যাসের নায়িকার আত্মহত্যার জন্য সেই বনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন।

বছরের পর বছর পেরোতে লাগলো কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলল। ১৯৭০ সাল থেকে আর্মি পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও সাংবাদিকরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সারা বছর জুড়ে রহস্য উদঘাটনে নিয়োজিত হয়ে পড়লেন। যতবারই তারা সুইসাইড ফরেস্টে গিয়েছেন, প্রত্যেকবারই লাশের সন্ধান পেয়েছেন কিন্তু কোনো কারণের হদিস তারা পাননি।

স্থানীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর এই আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে ১০০ ছাড়িয়েছে।

জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও জনকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৫ সালে এই বনে ২৪,০০০ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। কী ভয়াবহ একটা ব্যাপার!

আত্মহত্যার জন্য অনেকেই এই বনটাকে কেন বেছে নেয়-এর কারণ অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় তিন দশক আগে, জাপানের এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছিলেন এবং এই সারমর্মে আসেন, “তারা বিশ্বাস করেন যে এখানে কেউ তাদের লক্ষ্য করবে না এবং সফলভাবে তারা নিজেদের প্রাণনাশ করতে পারবে।”

ড. ইয়োশিতোমো তাকাহাশি নামের অপর এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন যে, এই বন নিয়ে চিত্রায়িত বিভিন্ন সিনেমা ও বিভিন্ন মিডিয়ায় উপস্থাপিত তথ্য উপাত্ত এই বনে আত্মহত্যার জন্য অনেককেই উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে।”

সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ অম্পর্কে সচেতনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যত সচেতনতা বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই বিষণ্ন বন যাতে আর কোনো মৃত্যু না দেখে সেই প্রচেষ্টা।

 

শবনম জাবীন চৌধুরী ইউনিভার্সিটি  অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

[email protected]

Share this news