Bangla
3 years ago

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস

Published :

Updated :

২০২১ সাল। চন্দ্রবিজয়, মহাকাশযাত্রার পর মানুষের চোখ এখন মঙ্গলে। দেশেও শোনা যাচ্ছে কত প্রযুক্তি, কত উন্নতির কোলাহল। কিন্তু জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের অধিকার পিষে রেখে মানব সভ্যতার মাননির্ধারণে আমাদের কতটুকু আগানো হলো?

নারী নির্যাতনে দেশ চতুর্থ, কর্মক্ষেত্রে নারী- পুরুষ বৈষম্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়, প্রতিদিন গড়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে চার জনেরও বেশি নারী; আর স্পষ্টরুপে বিরাজ করছে হাজারো পদে নারী অবমূল্যায়নের পুরনো অন্যায্যতা। নগরকেন্দ্রিকতায় মোড়ানো বেশিরভাগ সংগঠন নারী অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলেও গ্রামীণ নারীদের ভাগ্য বদলাচ্ছে ঠিক কতটুকু?

এমনই বাস্তবতায় ১৫ অক্টোবর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস, ২০২১। বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশ একযোগে পালন করছে দিবসটি। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৪র্থ নারী সম্মেলনে ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের প্রস্তুাব গৃহীত হয়।

১৯৯৭ সাল থেকে জেনেভা ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা Women’s World Summit Foundation (WWSF) দিবসটি পালনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে। এরপর ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ২০০৭ সালে। গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্রতা দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভুমিকার স্বীকৃতি স্বরুপ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে।

তবে যাদের জন্য এই দিবস তাদের সম্পৃক্ততা কতটুকু এই দিবসের সাথে? বিভিন্ন সভা সংগঠন এ দিবসকে সামনে রেখে নানাবিধ কর্মসূচী রাখলেও যাদের জন্য বিশেষায়িত এই দিবস তাদের বেশির ভাগই এদিনটি সম্পর্কে না কোনো ধারণা রাখতে পারে; না ধারণা রাখতে পারে তাদের অধিকার সম্পর্কে।

মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করে ক্ষান্ত হয়েই গ্রামীণ নারীরা স্বামী- সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। শুধু পরিবার নয়, বয়ে নিয়ে চলছেন এ সমাজ ও দেশকে। কিন্তু নিজের বেলায় জুটছে চরম অবমূল্যায়ন।

বিভিন্ন কুটিরশিল্প, ছোটখাট ব্যবসা বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় আগের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলক বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, শস্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন পর্যন্ত প্রতি ধাপে রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এতে আমাদের গ্রামীণ নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।

নারীরা শুধু শস্য উৎপাদন নয়, মাছ চাষ, পশুপালন এমনকি বাজারজাতের কাজেও সমানভাবে যুক্ত। তবে কৃষিতে নারীর এমন অংশগ্রহণের নাম দেওয়া হচ্ছে ‘পারিবারিক সাহায্য’। কৃষক হিসেবে না পরিবার থেকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, না সরকারিভাবে স্বীকৃতি মিলছে।

কৃষি থেকে আসা আয়েও নারীদের ভাগ শুন্য। তাছাড়া ভূমিতে নেই সমঅধিকার, নেই কৃষিঋণে। দৈনিক ১২-১৬ ঘণ্টা গৃহস্থালী কাজ হোক বা কৃষি- পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করে নারীদের এসব কাজ করতে হচ্ছে অবৈতনিক। অথচ এসব কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর মতামত প্রতিষ্ঠার সুযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈষম্য ও নির্যাতনের হার কমে আসার সম্ভাবনা অসীম।

তবে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই বেড়েছে যে স্বাবলম্বী হওয়াই নির্যাতন বা অবমূল্যায়ন রোধের একমাত্র পথ নয়। ২০০৫ সালে সাতক্ষীরার নওয়াবেকি গ্রামের উদ্যোক্তা শামীমা বেগম ‘শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’র পুরস্কার পান। এর অংশ হিসেবে বক্তৃতা দেন জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে। বাংলাদেশের জন্য কুড়িয়ে আনেন সম্মান, গ্রামীণ নারীদের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

সেই শামীমা বেগমকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দেন তার বর। শামীমা বেগমেরই প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকের সেবিকার সাথে সেই লোকের সখ্যতা গড়ে উঠলে তার প্রতিবাদ করতে গেলে শামীমা বেগমকে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জাতিসংঘে সম্মাননা পাওয়া সেরা নারী উদ্যোক্তার পরিণতি দাঁড়িয়েছে এই।

নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর রয়েছে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র। এ লক্ষ্যে তাদের যে বিশেষ সুবিধাগুলো দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষার সমান সুযোগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমাজের সার্বিক 'দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন'।

আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তেমন পার্থক্য না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে বেশ, যার কারণ বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, অভিভাবকের সদিচ্ছার অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা।

এখনও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন অকালে প্রাণ কেড়ে নেয় গৃহবধু ময়নাদের। সারা বছর হাড়ভাঙ্গা কৃষিকাজের বদলে রহিমা বেগমদের মাথা থেকে পায়ে বেঁধে দেওয়া হয় অদৃশ্য শিকল। ধর্ষণ করা হয় জীবন বাঁচাতে ত্রাণ নিতে আসা সুলতানাদের। আর কতগুলো আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পেরোলে গ্রামীণ নারীরা পাবেন তাদের যথাযথ মর্যাদা ও সমঅধিকার, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।

ফারিয়া ফাতিমা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করছেন

[email protected]

Share this news