Bangla
3 years ago

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তারকালে মানুষের অধিকার রক্ষা আইন জরুরি

ফেসিয়াল রিকগনিশন বা চেহারা নির্ণায়ক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিস্তারের একটি উদাহরণ
ফেসিয়াল রিকগনিশন বা চেহারা নির্ণায়ক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিস্তারের একটি উদাহরণ

Published :

Updated :

অ্যালগরিদমভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রযুক্তিকেই এতকাল অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন অ্যালগরিদমের সঠিক ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। অর্থাৎ অ্যালগরিদম প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো আগেভাগে খতিয়ে দেখতে হবে।

প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় মানুষের নেওয়া সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাই ঠিক করে নিয়োগ, বদলী এবং পদায়ন। বন্ধকের অনুমতি, এমনকী বন্দির কারাবাসের মেয়াদ ঠিক করার পেছনের গুটিও নাড়ছে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজে যন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে খুব বেশিদিন হয়নি। তবে যন্ত্র বলতে এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংক্ষেপে এআই-য়ের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এযন্ত্রের সিদ্ধান্ত মোটেও নিরপেক্ষ হচ্ছে না বরং অ্যালগরিদমভিত্তিক পক্ষপাত দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে। (অ্যালগরিদমের মানে হলো কোনো সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট নির্দেশের গাণিতিক সমষ্টি। আর এসব নির্দেশ দেওয়া হয় ধাপে ধাপে কাজ করার জন্য।) আটপৌরে জীবনের উপাত্তমালার ভিত্তিতেই অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কাজেই প্রতিদিনের জীবনে মানুষের পক্ষপাত থেকে যায় এসব উপাত্তে। ফল হচ্ছে এই যে, অ্যালগরিদমেরও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ থাকে না। সেখানে পক্ষপাতের কালো ছায়া ভর করে। এভাবেই বৈষম্যের দানব রক্তবীজের মতোই বাড়তে থাকে, বিনাশ হয় না। আমরা দেখতে পাই, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের চাকরির ক্ষেত্রে নারীকে পাশে ঠেলে দেওয়া হয়। যকৃত বা কিডনি প্রতিস্থাপনের বেলায় কালো রোগীকে পিছে ফেলে এগিয়ে যায় সাদা রোগী। কালো রোগীর অগ্রাধিকারকে বানচাল করে দেওয়া হয়।

ফাইনান্সিয়াল টাইমসের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক অঞ্জনা আহুজা

এমন পরিস্থিতি বাগে আনতে এবারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অধিকার নিয়ে বিল প্রস্তাব করলেন হোয়াইট হাউসের বিজ্ঞান উপদেষ্টারা। ১৭৯১-এ গৃহীত মার্কিন অধিকার বিলের অনুকরণেই প্রস্তাবিত বিলের খসড়া করা হয়েছে।অধিকার বিলে সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায় বিচার লাভের অধিকার রক্ষার মতো বিষয়গুলো ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা এরিখ ল্যান্ডার এবং হোয়াইট হাউজ অফিস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসির উপপরিচালক অ্যালনড্রা নেলসন মার্কিন মাসিক ওয়্যারডে লিখেছেন, “২১ শতকে আমাদের তৈরি শক্তিশালী প্রযুক্তিগুলোর ওপর নজরদারির জন্য এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ‘অধিকারবিল’এর।...বহুমানুষের ক্ষতি ডেকে আনবে এমন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণীয় নয়। একইভাবে, গাড়ি, শিশুর খেলনা বা চিকিৎসা যন্ত্রের মতো কোনো পণ্য বহু মানুষের ক্ষতি করবে তাও গ্রহণীয় নয়।”

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নতুন বিলে যে কারো জানার অধিকার থাকবে যে যদি এআই তাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে তা কীভাবে নিয়েছে। বাস্তব জীবনের পক্ষদুষ্ট অ্যালগরিদম থেকে মুক্ত থাকার অধিকার তার থাকবে। সবচেয়ে গুরুত্বের কথা হলো, এই আই যদি অন্যায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকারও থাকবে।

 

ল্যান্ডার এবং নেলসন এখন এ বিল প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসিবে  স্বর বিশ্লেষণ কারী বা ভয়েস অ্যানালাইসিস এবং চেহারা নির্ণয় বা ফেসিয়াল রিকগনিশনে ব্যবহৃত বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি নিয়ে শিল্প, রাজনীতি, নাগরিক সংস্থা এবং নাগরিকদের মধ্যে জনমত তৈরির কাজটি করছেন। এসব সমস্যা যেসব কোম্পানি দূর করেনি তাদের কাছ থেকে কোনো সফটওয়্যার বা প্রযুক্তি কিনতে সরকারের অস্বীকার করার এখতিয়ারও বিলে থাকতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত প্রক্রিয়ায় চলেছে যুক্তরাজ্য। নাগরিক-সম্পৃক্ততা থেকে নিরাপদ দূরত্বই বজায় রেখেছে দেশটি।বরং কয়েকজনের মাধ্যমে আইন প্রণয়নকে উপাত্তশিল্প বা ডাটা ইন্ডাসিট্র খাতে ব্রেক্সিটের লভ্যাংশ হিসাবে দেখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বসবাসকারী নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ হয়    জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর)। ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য জিডিপিআর সংশোধন করতে চাইছে। এ আইনের ২২ ধারায় এআই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার অধিকার নাগরিককে দেওয়া হয়েছে। ধারাটি বাতিল করতে বা ধারার ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব তুলেছে যুক্তরাজ্য সরকার। গতমাসে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা "উচ্চাভিলাষী, প্রবৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন-বান্ধব উপাত্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা" তৈরির নীল নকশা নিয়ে ব্রিটেনবাসীদের সঙ্গে ১০ সপ্তাহের শলা-পরামর্শ শুরু করেছেন।

অ্যাপভিত্তিক গাড়িচালকদের আইনি লড়াইকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য সম্প্রতি ২২ ধারাকে কার্যকর করে। উবার এবং ভারতীয় কোম্পানি ওলার চালকরা অভিযোগ করেন, এই কোম্পানিদ্বয়ের স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগৃহীত উপাত্তের ভিত্তিতে আর্থিক শাস্তিসহ নানা সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছেন তারা। নিজ নিজ উপাত্ত খতিয়ে দেখার আরো স্বাধীনতা চালকদের দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। ব্যাপকভাবে স্বয়ংক্রিয় ‘গিগ’অর্থনীতির শ্রমিকদের কাছে এই নির্দেশ খুবই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ( ‘গিগ’অর্থনীতি বলতে এমন একটি মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে বোঝান হয় যেখানে সাধারণভাবে কাজগুলো অস্থায়ী এবং কোম্পানিগুলো স্বল্পমেয়াদে শ্রমিক নিয়োগ করে।)

ল্যান্ডার এবং নেলসন প্রস্তাবিত বিলকে ব্যাপক সমর্থন দেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই নীতিশাস্ত্র গবেষক শওনা কনকানন। তাঁর যুক্তি হলো, ভুলভালে ভরা এআই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটা নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যেই পড়ে। তিনি আরো বলেন, “মানুষ অনেক সময়ই মনে করে, অ্যালগরিদম হলো অতিমানব। কথাটা ঠিক আছে এই অর্থে যে তথ্য দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে অ্যালগরিদম ।কিন্তু আমরা জানি, তাদের কাজটা দোষক্রটিতে ভর্তি থাকে।”

অ্যালগরিদমভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রযুক্তিকেই এতকাল অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন অ্যালগরিদমের সঠিক ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। অর্থাৎ অ্যালগরিদম প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো আগেভাগে খতিয়ে দেখতে হবে।

কালো বাক্স মানে কম্পিউটারের ভেতরে কিভাবে কাজ চলছে তা খতিয়ে দেখার জন্য হালে সৃষ্টি হয়েছে, "ব্যাখ্যাযোগ্য এআই।"  সংশোধনমূলক তৎপরতা দেরিতে নেওয়া হয়েছে বলে একে অভিহিত করা যায়। সমাজ দেহে জানাশোনা যেসব ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, এগুলো যথেষ্ট নয়। এককালে সরকারের হাতে যে অসীম ক্ষমতা থাকত এখন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর হাতে তাই রয়েছে। জনকল্যাণ নয় বরং ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করাই এসবের উদ্দেশ্য। একারণেই বিশ্বজুড়ে এআই অধিকার সংক্রান্ত আইন দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

[ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে বাংলায় রূপান্তর সৈয়দ মূসা রেজা]

Share this news