Bangla
2 years ago

জীবনতরী, জলের বুকে ভেসে বেড়ানো এক আস্থার নাম

জীবনতরী। ছবি: ইম্প্যাক্ট ফাউন্ডেশনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে
জীবনতরী। ছবি: ইম্প্যাক্ট ফাউন্ডেশনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে

Published :

Updated :

নদী পাড়ের যে মানুষগুলোর দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোগাড় করতেই নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়, তাদের কাছে চিকিৎসা সেবা সাধ্যের বাইরে খুব প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক চাহিদা। সামর্থ্য নামের এক আপেক্ষিক সেতুর এক পাশে থাকে এই মানুষগুলো আর অন্যপাশে চিকিৎসা সেবা। তবে বিগত ২৩ বছর যাবত নদী পাড়ে বসবাসরত অসংখ্য প্রান্তিক আয়ের মানুষের কাছে ‘জীবনতরী’ হয়ে উঠেছে এক নতুন আশা এবং ভরসার নাম। কিন্তু কীভাবে?

জীবনতরী বাংলাদেশের একটি ভাসমান হাসপাতালের নাম। ভাসমান এবং হাসপাতাল এই শব্দ দুটির মিশেল প্রথম প্রথম সকলের কাছেই অনেকটা বিস্ময়ের আর খানিকটা ভ্রুকুটির বিষয় ছিল। নদীপাড়ে বসবাসরত অসংখ্য মানুষের দ্বারে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই ভাসমান হাসপাতালটি।

এই হাসপাতালের পথ চলা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ১০ এপ্রিল। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া নদীতীরে জীবনতরীর শুভ উদ্বোধন এবং কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত নদী পাড়ের মোট ২২টি জেলার ৩৩টি এলাকার মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিয়েছে এই ভাসমান হাসপাতাল। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে জীবনতরী ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে।

ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (আইএফবি) নামক একটি সেবা প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে এমন মহৎ উদ্যোগের বাস্তবায়ন হয়েছে। এটি বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং একই সাথে এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের অসহায় এবং হতদরিদ্র মানুষদের জীবনের মানোন্নয়নের জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় শতাধিক স্বল্প আয়ের বিভিন্ন বয়সের মানুষ এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য ৫০ টাকা সমমূল্যের টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা ও অপারেশনের জন্য স্বল্পমূল্যের নানা প্যাকেজ রয়েছে।

একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের আদলে জীবনতরীকে সাজানো হয়েছে এবং রয়েছে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই ভ্রাম্যমান হাসপাতালের ভেতরে স্বল্প পরিসরে সবই রয়েছে, যেমন - প্যাথলজি কক্ষ, রোগীর শয্যা, অস্ত্রোপচারকক্ষ, পোস্ট অপারেটিভ কক্ষসহ অন্যান্য সুবিধাসমূহ। ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে ৩ জন মতান্তরে ৪ জন চিকিৎসক নিয়মিত রোগীদের সেবা প্রদান করে চলেছেন। এছাড়াও রয়েছে বেশকিছু নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য সহায়ক কর্মীগণ। এই হাসপাতালেই তাদের থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।

রোগীর এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষাসহ আরো কিছু পরীক্ষানীরিক্ষার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। চক্ষুরোগের চিকিৎসা, যেমন - ছানি অপারেশন, ফ্যাকো সার্জারি করা হয়। এখানে নাক, কান, গলার নানা সমস্যা; ঠোঁট কাটা, তালু কাটা, হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা, নানাবিধ ব্যথার চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এসবই স্বল্প মূল্যের মধ্যে সম্পন্ন করা হয় যাতে করে তা দরিদ্র মানুষগুলোর সাধ্যের মধ্যে থাকে। এছাড়াও শারীরিক অসম্পূর্ণতা বা অঙ্গহানি হয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক সামগ্রী প্রদান করা হয় এখান থেকে।

‘স্বল্প মূল্যে সেবা প্রদানের’ বিষয়টা থেকে অনেকের মনে ‘সেবার মান’ নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। তবে বিভিন্ন সময়ে সেবা গ্রহণকারী অনেকের সাথে কথা বলে সন্তোষজনক উত্তর মিলেছে যা সেবার গুণগত মানকে সুনিশ্চিত করে।

এছাড়াও নদীপাড়ের দুস্থ এবং অবহেলিত মানুষগুলোর মাঝে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে এখানে সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেমন-পুষ্টি, শারীরিক অক্ষমতা রোধ, নিরাপদ মাতৃত্ব।

সবশেষে একটি বিষয় বোধহয় জানা বাকি রয়ে যায়। আচ্ছা, গঠনগত দিক দিয়ে জীবনতরী কি একটি নৌকা নাকি লঞ্চ বা কোনো স্টীমার? এটি একটি তিনতলা বিশিষ্ট নৌকা। এই নৌকাকে নদীর কূলে কূলে বয়ে নিয়ে চলেছে একটি টাগবোট (জেটি বা বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো বা ছাড়ার সময় টেনে তোলা বা ঠেলার কাজে সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে টাগবোট ব্যবহার করা হয়)। এই নৌকাটি ইস্পাতের তৈরি এবং ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিনেন্স অব বাংলাদেশ এবং দ্য লয়েডস রেজিস্টার অব শিপিং ইনল্যান্ড রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনসের নিয়ম মেনে এটি নির্মাণ করা হয়েছে।

শবনম জাবীন চৌধুরী ইউনিভার্সিটি  অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

[email protected]

Share this news