Bangla
2 years ago

জুলাইয়ে অর্থনীতির ৪ সূচকে উন্নতি: ধরে রাখার তাগিদ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

Published :

Updated :

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আমদানি কমেছে, নেতিবাচক ধারায় থাকা রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে, মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমেছে আর আগের মতই ইতিবাচক ধারা বজায় রেখেছে রপ্তানি আয়। অর্থনীতির এই চার সূচকে কিছুটা উন্নতি যে আশার আলো দেখাচ্ছে তা ধরে রাখতে বর্তমান সতর্কতার পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখার তাগিদ এসেছে দুই বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই চার সূচকের হালনাগাদ তথ্য ইতিবাচক। তবে একমাসের প্রবণতা দিয়ে অর্থনীতির গতিধারা ঘুরে গেছে তা বলা ঠিক হবে না।

এজন্য সরকার আমদানি ও রপ্তানি তদারকির যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববাজারে কমে আসা পণ্যের দামের প্রভাব যাতে দ্রুত দেশের বাজারে দেখা যায়- সেদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত ও সেলিম রায়হান।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে লকডাউন উঠে গেলে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক কার্যক্রম ঘুরে দাঁড়াতে থাকে; আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও গতিশীল হতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশও নানামুখী চাপে পড়ে।

আমদানি ব্যয় ও পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার উপর বিশেষ করে ডলারের উপর চাপ তৈরি হয়। মূল্যস্ফীতির পারদ বেড়ে ৯ বছরের সর্বোচ্চে পৌঁছায়। হঠাৎ করে কমে আসে রেমিটেন্স। তবে গত অর্থবছরজুড়ে স্বস্তি দিয়েছে রপ্তানি আয়।

গত ২০২১‌২৩ অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি এবং দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি দেখা দেয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে রেকর্ড ৯৫ টাকা ছুঁইছুঁই।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্যোগের এবং রেমিটেন্স বাড়াতে নেওয়া প্রণোদনা ও শর্ত ছাড়ের কিছুটা সুফল মেলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে।

টানা ছয় মাস বাড়ার পর জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। চলতি পঞ্জিকা বছরের ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা জুন পর্যন্ত টানা বেড়ে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়।

একই সঙ্গে ডলার সাশ্রয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নানা পদক্ষেপে এক মাসের ব্যবধানে জুলাইতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ। জুনের তুলনায় প্রায় ২৪৯ কোটি ডলারের এলসি খোলা কমেছে। জুনে যেখানে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, তা জুলাইয়ে নেমে আসে প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে।

এসব এলসির পণ্য দেশে আসবে আগামি মাসগুলোতে। তখন আমদানি ব্যয় মেটাতে আগের চেয়ে কম বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে। এটি ডলার সংকট কমাতে কিছুটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, মোট ৩৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

আর রেমিটেন্সও ১৪ মাস পর ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছর যেখানে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল; সেখানে জুলাইতে ২১০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি।

এমন প্রেক্ষাপটে নানামুখী সংকটের মধ্যেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অর্থনীতিতে ভালো কিছু হওয়ার আশা প্রকাশ করেন।

অর্থমন্ত্রী আগামী এক দুই মাসের মধ্যে অর্থনীতিতে গতি তৈরি হবে জানিয়ে তা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

আর বৃহস্পতিবার গভর্নর মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ‘ভালো খবর’ আসছে।

চার সূচকে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক উন্নতি অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব রাখবে জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমে আসার বিষয়টি স্থায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন প্রয়োজনীয় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো অব্যাহত রাখতে হবে।

বিশেষ করে মুদ্রা পাচার রোধে আমদানি প্রক্রিয়ায় ‘কঠোর মনিটরিং’ চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

অনেকে ডলারের দাম বাড়িয়ে বেশি আয় করতে ‘কৃত্রিমভাবে ডলারের সংকট’ তৈরির চেষ্টা করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ প্রচেষ্টাকে কঠোর মনিটরিং করে ডলারের লেনদেন প্রক্রিয়া এবং টাকার মান নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ চলমান রাখা উচিত।“

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান এ চার সূচক ইতিবাচক থাকা স্বস্তির।

তবে এক মাসের তথ্যকে স্থায়ী ইতিবাচক ধারা ধরে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বরং সরকার সতর্ক হয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল সেগুলোকে অব্যাহত রাখতে হবে।

তিনি বলেন, “বিশ্ববাজারে অনেকগুলো পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসায় মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ছে।

“যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে যে হারে পণ্যমূল্য কমেছে তার প্রভাব দেশে পড়ছে না। অর্থাৎ আমদানি পণ্যের মূল্য যে হারে কমার কথা সেভাবে কমছে না।“

বিষয়টি কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।

রাশিয়া- ইউক্রেইন যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি এবং নতুন করে তাইওয়ান-চীন উত্তেজনা বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলার আশংকা তৈরি করছে জানিয়ে তিনি সরকারকে নতুন করে সতর্ক হতে বলেন।

অর্থনীতির এই অধ্যাপক জুলাইতে রেমিটেন্সকেই বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এক বছর ধরে নেতিবাচক থাকার পর ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি স্বস্তির।

তিনি মনে করেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া রপ্তানিতে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। এতে রপ্তানি আয় আরও বাড়তে পারে।

তবে রপ্তানি বহুমূখীকরণের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীও রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে অনেক দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক এবং উদ্যোক্তাদের সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।

বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, হাল্কা প্রকৌশল শিল্প রপ্তানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ওপর পরামর্শ রাখেন তিনি।

সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণেও বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

Share this news