Bangla
3 years ago

মোসাদের হাতে খুন হওয়া থেকে যেভাবে বেঁচেছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক

আবদুল কাদের খান
আবদুল কাদের খান

Published :

Updated :

আবদুল কাদের (এ. কিউ) খান ইন্তেকাল করেছেন চলতি মাসের ১০ তারিখে। ৮৫ বছর বয়সে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। স্বদেশভূমি পাকিস্তানে তিনি কিংবদন্তীর বীরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। দুনিয়া তাঁকে “পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক” হিসেবে চেনে। তবে একইভাবে তাকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গডফাদার বা ধর্মপিতা বলেও ডাকা যায়।

তাঁর জন্ম হয় ভারতে, ১৯৩৬ সালে। দেশ বিভাজনের পর ১৯৫২ সালে তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজে সেন্ট্রিফিউজ তৈরিতে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের জন্য ১৯৭২ সালে ৩৬ বছর বয়সী কাদের খানকে হল্যান্ডের একটি গবেষণাগার এবং কারখানায় পাঠানো হয়। ইউরোপীয় ইউআরইএনসিও কনসোর্টিয়ামের আওতাধীন ছিল এটি।

কাদের খান ১৯৭৫-এ সেখান থেকে তাদের নথি এবং নীল নকশা হাতিয়ে নেন, চুরি করেন। হল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর তৎপরতা ধরে ফেলে, ফলশ্রুতিতে কাদের খান পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ভারতের পরমাণু কর্মসূচির সাথে তাল রাখার জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেশটির পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে রাজী করান কাদের খান। ভুট্টো অবশ্য প্রথমে গড়িমসি  করছিলেন।

বিশুদ্ধ কাকতালীয়ভাবে একই বছর আর্নন মিলচেন নামের এক ইসরায়েলি গুপ্তচরও একই ধরণের চুরি করেন। মিলচেন এবং ইসরায়েলের ‘সায়েন্টিফিক লিয়াঁজো ব্যুরো’-র গোয়েন্দা সংস্থা জার্মান এক প্রকৌশলীর কাছ থেকে ইউআরএনসিও-র সেন্ট্রিফিউজের নকশা কেনেন। ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচির জন্য অনুরূপ সেন্ট্রিফিউজ তৈরি করা হয় ডিমোনায়। মিলচেন পরবর্তীতে হলিউডের ধনকুবের হয়ে ওঠেন। তিনি রিজেন্সি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৩০টিরও বেশি পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি।  

১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আমলে পাকিস্তান প্রথম পরমাণু পরীক্ষা চালায়। তবে এ পরীক্ষা চালানোরও বেশ কয়েক বছর আগেই পাকিস্তান পরমাণু সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেই ধারণা করা হয়।

পাকিস্তানকে উল্লেখযোগ্য পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলতে সহায়তার পর অবসর নেন কাদের খান। এর মধ্যেই তিনি গড়ে তোলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিগত ব্যবসা। দুবাইতে তিনি একটি দোকান দিলেন। আর দোকান থেকে বিশ্বজুড়ে নিজ পরমাণু জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি বিক্রির এক গোপন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এদের মাধ্যমে পরমাণু কর্মসূচি তৈরিতে আগ্রহীদের সহায়তাকারী, প্রকৌশলী, ঠিকাদার এবং অর্থনৈতিক যোগানের ব্যবসায় নামেন। সরলপথে, সোজাভাবে এ কাজ করা হয়নি। জটিল এবং চূড়ান্ত ঘোরপ্যাঁচের মাধ্যমে এবং গোপনীয়তার সাথে এসব কাজ করা হতে থাকে। তিনি মালয়েশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং সুইজারল্যান্ডসহ দুনিয়ার অনেক জায়গায়ই ভাড়া করেন কারখানা, দফতর এবং কম্পিউটার কেন্দ্র।

‘প্রথম মুসলমান পরমাণু বোমা’ নির্মাণকারী হিসেবে পরিচিতি পান কাদের খান। পরমাণু প্রতিভার জ্যোতির্ময় আলখাল্লা চাপিয়ে ১৯৮০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্য দাপিয়ে বেড়ান এবং নিজের পরমাণু সেবা বিক্রির প্রস্তাব দেন বিভিন্ন দেশের সরকারকে। ‘ফেলো কড়ি, বানাও বোমা’ জাতীয় তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় মিশর, সৌদি আরব, আলজেরিয়া এমনকি সিরিয়াও। তবে ইরান ও লিবিয়া তা গ্রহণ করে প্রস্তাবিত শর্ত এবং কাজের পরিসীমার রদবদল ঘটিয়ে।

পরমাণু অবকাঠামো বা বিশেষজ্ঞজন বলতে কিছুই ছিল না লিবিয়ার। কাদের খানের কাছে মোয়াম্মার গাদ্দাফি সে সময় দাবি করেন, ত্রিপোলিকে পুরোপুরি পরমাণু প্রকল্প গড়ে দিতে হবে এবং পরমাণু সক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাদের খানকেই দায়িত্বশীল হতে হবে।

অবশ্য, ইরান পরমাণু কর্মসূচিতে এগিয়ে ছিল এবং দেশটিতে একাধিক উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বিজ্ঞানী। এদের অনেকেই পশ্চিমের খ্যাতিমান শিক্ষাকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তবে এরপরও ইরান তাঁর নিজের পথ পছন্দ করে নেয়।

কাদের খানের কাছ থেকে পি ১ এবং পি ১ সেন্ট্রিফিউজের নকশা কিনে নেয় ইরান। পরে ড. মোহসিন ফখরিজাদেহের নেতৃত্বে ইরান নির্মাণ করে আইআর ১ এবং আই আর ২ সেন্ট্রিফিউজ। ২০২০’এর ২৭ নভেম্বর মোসাদের ঘাতক বাহিনী রাজধানী তেহরানের উপকণ্ঠে এই খ্যাতনামা বিজ্ঞানীকে খুন করে।

পরবর্তীতে সেন্ট্রিফিউজের আরো ব্যাপক উন্নয়ন করেছে এবং আইআর ৩, ৪,৫,৬,৭ নামে ধারাবাহিক সেন্ট্রিফিউজ তৈরি করছে ইরান। ইরানের নাতাঞ্জ এবং ফোরদু পরমাণু স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজে এ সব সেন্ট্রিফিউজ তৎপর রয়েছে। ইসরায়েল, আমেরিকাসহ পশ্চিমী দুনিয়ার মাথা ব্যথা হয়ে উঠেছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। ইরান বারবার নিজ পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ হিসেবে দাবি করে আসছে। এছাড়া, ইরানে রাহবার হিসেবে পরিচিত সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি পরমাণু বোমা তৈরি এবং ব্যবহারকে স্পষ্টভাষায় হারাম হিসেবে ফতোয়া দিয়েছেন।

তৎকালীন মোসাদ প্রধান শবতাই শাভিতের নেতৃত্বে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যে কাদের খানের ব্যাপক ঘোরাঘুরি ওপর শ্যেন নজর রাখছিল। কিন্তু, শাভিত দেড় দশক আগে হারেৎসের সাংবাদিক ইয়োসি মেলম্যানের কাছে স্বীকার করেন যে কাদের খান কেন এমন ঘোরাঘুরি করছেন মোসাদ এবং  আমান (ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা) তা মোটেও ঠাহর করতে পারেনি।

ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতীক

শাভিত আরো বলেন, তিনি বা তাঁর সহযোগীরা যদি কাদের খানের পরিকল্পনার সামান্য আভাসও পেতো, তবে তাকে খুন করার জন্য মোসাদের ঘাতক দলকে পাঠাতো। আর এতে “ইতিহাসের গতিপথ বদলে” দেওয়া যেত। অন্তত ইরান-ইসরাইলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটত বলে মনে করেন তিনি।

কাদের খানের তৎপরতা যে ভাবে হলো ফাঁস

২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর লিবিয়ার নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফি ভয় পান। এরপরই তাঁর পালা বলে ধরে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে টানাপড়েন কবর দিয়ে সুসম্পর্ক তৈরির তাড়না অনুভব করেন। ১৯৮৮ সালে প্যান অ্যাম বিমানে বোমা বসানো, স্কটল্যান্ডের লকারবির আকাশে বিমান ধ্বংস হওয়াসহ দুনিয়াজুড়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।

সিআইএ এবং এমআইসিক্সের সঙ্গে আলোচনায় বসেন গাদ্দাফি। কাদের খান কীভাবে তাঁর জন্য পরমাণু কর্মসূচি স্থাপনা তৈরি করছে সে সংক্রান্ত সব নথিপত্রও তুলে দেন তিনি মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাতে। এ সব স্থাপনার কোনো কোনোটি মুরগির খামারের আড়ালে কাজ করে গেছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-র সহযোগিতায় সিআইএ এবং এমআইসিক্স গাদ্দাফির এসব পরমাণু স্থাপনা এবং রাসায়নিক কর্মসূচি গুড়িয়ে দেয়।  

তবে দুই গোয়েন্দা সংস্থাই এ বিষয়টি পুরোপুরি ধামাচাপা দিয়ে রাখে। ২০০৪ সালে বিবিসির খবরে এ বিষয়টি দুনিয়া প্রথম জানতে পারে। এতে প্রায় বজ্রাহত হয়ে যায় মোসাদ এবং আমান। চলতি কথায় বলা যায় “পুরাই বোকা বনে যায়!”

তবে এ খবরের সূত্র ধরে আবার অতীতকে খুঁড়তে শুরু করে ইসরায়েল। এবারে তারা জানতে পারে সিরিয়া প্লোটনিয়াম উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি মরুভূমিতে পরমাণু চুল্লী বসাচ্ছে। ইরানও নয়, কাদের খানও নয় বরং সিরিয়াকে এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। ২০০৭ সালে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় সে চুল্লি।

কাদের খানকে ঠেকাতে ব্যর্থ সিআইএ: মোসাদ কেবল নয়, সিআইএ-ও কাদের খানের পরমাণু বোমা বিস্তারের মুক্ত ব্যবসা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রুড লাবার্স জানান, দেশটি থেকে কাদের খানের পরমাণু প্রযুক্তি হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা জানত সিআইএ। তবে তারপরও পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানানো ঠেকাতে তেমন কিছু করেনি। এছাড়া, দুবাইয়ে খানের ব্যবসার এক সুইস সহযোগী আসলে সিআইএ-র চর ছিল। সিআইএ সুইজারল্যান্ডে কাদের খানের তৎপরতা বানচাল করে দিয়েছিল এবং তাঁর দলের কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার হয়েছিল। তার আর পর নেই- মানে সিআইএ আর এগোয়নি।

২০০৪-এ লিবিয়ায় তৎপরতা ফাঁস হওয়ার পরও আইএইএ-র লোকদের কাদের খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেয়নি পাকিস্তান। পরে পাকিস্তান টিভিতে কাদের খান তাঁর তৎপরতার স্বীকারোক্তি দেন। তিন জানান, তাঁর এ ব্যবসায় পাকিস্তান জড়িত ছিল না বা এমন ব্যবসার কথা জানতোও না। তাই তাকে মাফ করে দেন তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। কিন্তু কাদের খানকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তবে পাকিস্তানের মানুষের কাছে তিনি কিংবদন্তীর বীর হয়েই থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর শোক বার্তায় পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘পাকিস্তানের জনগণের কাছে কাদের খান ছিলেন জাতীয় বীর।’

কাদের খানের জীবনের অন্যতম বিস্ময়কর ঘটনা হলো, তিনি সেই সব হাতে গোণা বিজ্ঞানীদের অন্যতম যারা ইসরায়েলের ঘোরতর দুশমনকে পরমাণু বোমা প্রযুক্তি অর্জনে সহায়তা করেছেন। ফলে ‘খেলা ভাঙ্গার খেলার’ মতো সমর কৌশল অর্জন করে দেশগুলো। তারপরও তিনি ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে খুন হওয়া থেকে প্রাণে রক্ষা পান।

[হারেৎস অবলম্বনে] 

 

Share this news