আমি ১৯৮৯ সাল থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করছি। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল বই কম্পোজ করা। অ্যাপল ম্যাকিনটশে বিজয় কীবোর্ডে সুতন্বী ফন্টে বাংলা টাইপ করতাম। তখন বাংলা ফন্ট যেটা বই ছাপায় ভাল লাগত সেটাই আমাদের বিবেচ্য ছিল। সেটা বিজয়। ক্রমে ক্রমে পিসি কম্পিউটার ইংরেজি ও বাংলা টাইপরাইটারের স্থলাভিষিক্ত হল। টাইপরাইটার ব্যবহার প্রায় উঠে গেল।
তারপর এল ইন্টারনেট, ই-মেইল চালু হয়ে গেল। তখনো কম্পিউটারের ক্ষমতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারণা ছিল না। প্রায় বিশ বছর ধরে ইংরেজিতে ই-মেইল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে দেখলাম ওয়েবপেজ ও অনলাইনে খবরের কাগজ। পরে বিদেশে এসে দেখলাম কম্পিউটারের ব্যাপক ও বিচিত্র ব্যবহার।
পঁচিশ বছর পূর্বে, হয়তো আরো পূর্বে, পিসির যাত্রা যখন শুরু তখনই চীন কম্পিউটারের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের সকল ভাষার সকল জ্ঞানকে সহজলভ্য করে ফেলেছিল। তাই সে আজ আমেরিকার সাথে পাল্লা দিচ্ছে। আমরা কি পারতাম না আমাদের তরুণ বিজ্ঞানীদের দিয়ে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে তেমন মৌলিক কাজ করাতে? অনুবাদক সফটওয়্যার তৈরি করাতে? ওসিআর ও ভয়েস রিকগনাইজার তৈরি করাতে?
চাহিদা থাকলে হয়তো কিছু কাজ হতো। ষোল কোটি মানুষের দেশে কম্পিউটারের চাহিদাই বা কত? অনুবাদ যন্ত্রের চাহিদা নেই। কারণ কী? বেশিরভাগ মানুষতো এখন শিক্ষিত! শিক্ষিতদের অধিকাংশ সব কাজ তারা ইংরেজিতে করে। সাহিত্য ছাড়া বাংলা আর কোন কাজে লাগে না!
বিশ্বের সকল উন্নত দেশে তাদের ভাষার একটি মাত্র কীবোর্ড বা কীবোর্ড লেআউট। কিন্তু আমাদের ভাষায় অনেকগুলি কীবোর্ড । আগে বিজয় দিয়ে ফেসবুকে কিছু লেখা যেত না, ই-মেইলে লেখা যেত না। অথচ অভ্র দিয়ে লেখা যেত। এখন অবশ্য বিজয় ইউনিকোড নামে একটি ফন্ট পেয়েছি, সেটা দিয়ে ই-মেইল ও ফেসবুকে লিখতে পারছি।
সেদিন শুনলাম বাংলা ওসিআর তৈরি হচ্ছে। তা দিয়ে একটি পুরাতন বই স্ক্যান করলে সেই স্ক্যানকৃত বাংলা কোন হরফে দেখতে পাব? অথবা কিভাবে সম্পাদনা করব? বিজয়ে? না অভ্রে? এসব প্রশ্নের জবাব পাচ্ছি না। পুরাতন বইতো অভ্র বা বিজয় – কোনটাতেই ছিল না। সেই ওসিআর-এর কথা শুধু শুনলাম, কাজে লাগাতে পারলাম না।
যখন বাংলা টাইপরাইটার ছিল তখন তার কীবোর্ডের লেআউট করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। প্রকৃত পক্ষে মুনির অপটিমার বাংলা কীবোর্ড অনেক বেশি বিজ্ঞান সম্মত ছিল। কারন মুনির চৌধুরী বাংলাভাষায় বাংলা অক্ষর ও চিহ্নর ব্যবহারের পৌন:পৌনিকতা হিসাব করে সেগুলিকে সেই সব আঙ্গুলের নিচে বসিয়েছিলেন যেখানে যেটা প্রযোজ্য। অভ্র অবশ্য কয়েকটি কীবোর্ড ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে; তার মধ্যে মুনির অপটিমা, ফোনেটিক ও জাতীয় কীবোর্ড নামে কীবোর্ড রয়েছে। জাতীয় কীবোর্ড বলে যে কীবোর্ড তৈরি হয়েছে সেটি বিজয় ইউনিকোডের কাছাকাছি।
কম্পিউটারকে অবলম্বন করে সারা দুনিয়া যখন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা নিছক ফন্ট ও প্রমিত কীবোর্ডের অভাবে যেখান থেকে আরম্ভ করেছিলাম সেখানেই বই ছাপার কাজে থেমে আছি।
আমি যতদূর জানি, আরবি, ফারসি, উর্দু, ফরাসি, ইটালি, জর্মানি ভাষার কীবোর্ড একটা, অনেক নয়। জাপানি, কোরিয়ান ও চাইনিজ ভাষার কীবোর্ডের কথা বললাম না। বাংলাদেশে এমন একটি বাংলা প্রমিত কীবোর্ড থাকা প্রয়োজন।
ফজলে রাব্বি: জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক