Bangla
10 months ago

১৯৭১, সেই সব দিন

Published :

Updated :

ইনামুল হকের গল্প নিয়ে হৃদি হকের পরিচালনায় সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত সিনেমা '১৯৭১, সেই সব দিন '। 

সিনেমার গল্প এগিয়েছে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা প্রতিদিনের টুকরো টুকরো ঘটনার মতো, মাঝে মাঝে প্রবাহমান জীবনের বয়ানশৈলী, দিন তারিখের বিবরণ, অন্য রকম একটা অনুভূতি এনে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সিনেমাই হয়েছে, তবে তার প্রায় সবগুলোই গ্রামীণ পটভূমিতে, কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প নিয়ে। কিন্তু হৃদি হকের ‘১৯৭১, সেই সব দিন’ একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উচ্চবিত্ত,বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত,গ্রামীণ নিম্নবিত্ত, হিন্দু-মুসলিম, পরিবারগুলোর মধ্য দিয়ে পুরো দেশের খন্ড চিত্র বেশ সফল ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন হৃদি হক। 

১৯৭১-এর মার্চ থেকে গল্পের শুরু। স্বাধীনতার দাবীতে পুরো ঢাকা শহর উত্তাল। প্রতিদিনই মিছিল বেরোচ্ছে। ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরীজীবী, সংস্কৃতিকর্মী সহ সকল মুক্তিকামী মানুষ সবাই যে যার জায়গা থেকে কাজ করছে, ঘরে বাইরে আলোচনা চলছে কোন দিকে গড়াচ্ছে পরিস্থিতি! 

চোখে সবার স্বাধীন দেশের, নতুন পতাকার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে কত উদ্বেগ, কত আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি , লক্ষ লক্ষ প্রাণের আত্মদান, সম্পর্কের টানাপড়েন – সব কিছু নিয়েই এগিয়ে গেছে গল্প, বিজয়ের দিন নতুন শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে নতুন দেশ আর নতুন পতাকার অধিকার অর্জন পর্যন্ত। 

২৫ শে মার্চ থেকে ধারাবাহিকভাবে যেভাবে সিনেমার গল্প এগিয়ে গেছে, দর্শকরা প্রতিটি মুহুর্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবে, এমনই জীবন্ত করে একাত্তরের দিনগুলো দেখা গেছে।

দর্শকরা ভাবতে বাধ্য হবে যে হৃদি হক, যিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তিনি কি দারুণভাবে ৫২ বছর আগেকার দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে এনেছেন। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে মানুষের চিন্তা চেতনা, আবাসন, ফ্যাশন সবই অনেক বদলে গেছে। তারপরও হৃদি হক সেই একাত্তরের দিনগুলো চমৎকার ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। 

গল্পের শুরু হয় মূলত দুটো পরিবার নিয়ে, তারপর যুক্ত হয় আরো পরিবার। গল্পের প্লট শহর ছাড়িয়ে চলে যায় দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলে। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, হিন্দুদের উপর অত্যাচার, মা-বোনদের উপর নির্যাতন, রাজাকারের ভূমিকা, অনেক কিছুই চমৎকারভাবে উঠে এসেছে সিনেমার গল্পে।  

বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই পুত্রবধু আর নাতিকে নিয়ে ঢাকার শান্তিবাগে আলম সাহেবের সংসার। এই যৌথ পরিবারের বড় ছেলে লিটু ও তার স্ত্রী তারিনের মানসিকতা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারিন বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। তাদের সাথে পাকিস্তানি উচ্চ মহলের সাথে বেশ দহরমমহরম ভাব। সবাই যখন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের  স্বপ্নে বিভোর, তখন তারা পার্টি আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত। মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন  নিতান্তই শিশুসুলভ চাওয়া তাদের কাছে। 

সামনের বাড়িতে এক হিন্দু পরিবার, সানজিদা প্রীতি সেই পরিবারের বড় মেয়ে। এ বাড়ির মুসলমান ছোট ছেলে  সজলের সঙ্গে তার খুনসুটি চলছে, এভাবেই শুরু হয় গল্প। 

২৫ মার্চের  ভয়াবহতা শহরজুড়ে প্রচণ্ড গুলির শব্দের ভেতরে দুই পরিবারের যে আতংক, তা যেন সারাদেশের এক খন্ড চিত্র। একই পরিবারের বড় ছেলে আর তার বউ এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মতের বিরোধের মাঝে যেন পুরো দেশের মানুষের একাত্তরের দিনগুলোর জীবন চিত্র উঠে এসেছে। 

যেখানে প্রায় সবাই মুক্তির জন্য ছটফট করছিলো, তখনো কেউ কেউ ছিলো দ্বিধাগ্রস্ত, কোন পথ বেছে নেবে বুঝতে পারছিলো না। দিন পঞ্জিকার পাতা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবারের মানুষের মানসিকতাও বদলায়। পরিবারের বড় ছেলে লিটু অনুভব করতে পারে স্বাধীনতার প্রয়োজন, শেষ পর্যন্ত বড় বউও হয় দ্বিধাগ্রস্ত। নাম মাত্র মূল্যে সানজিদা  প্রীতি, বিন্তির হিন্দু পরিবারের বাড়ি বিক্রিও মুক্তিযুদ্ধের করুন একটা চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিছু কিছু মুহুর্তের খুঁটিনাটি দৃশ্য এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে তা বাস্তবতা আর সিনেমার পর্দার তফাৎ ঘুচিয়ে দেয়; তাদের দু:খ, বেদনা, আনন্দ দর্শককে ছুঁয়ে যায়।

ফেরদৌস, হৃদি হক, লিটু আনাম, সজল, সানজিদা প্রীতি, আবুল হায়াত সহ অনেক জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীর সম্মিলন ঘটেছে সিনেমায়। ফেরদৌস, সানজিদা প্রীতির অভিনয় দর্শকের ভালো লাগবে। সঞ্জু চরিত্রে ফেরদৌস এবং বিন্তি চরিত্রে সানজিদা প্রীতি সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবদ্য অভিনয় করেছেন। 

বন্ধুরুপী রাজাকারের সহযোগিতায় যার বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো স্বাধীনতার লাল সূর্য, তার প্রস্থান কাঁদিয়েছে দর্শকের অন্তর। লিটু আনাম, তারিন বেশ ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের চরিত্রগুলো। তারিনের অভিনয়ের সাথে তার সাজসজ্জা ছিলো তৎকালীন সময়ের উপযুক্ত।

হৃদি হকের পরিচালনা, সিনেমার কাহিনী এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডের কথামালা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ফেরদৌসের বিপরীতে তার অভিনয় কিছুটা অপূর্ণ মনে হয়েছে। 

কিছু কিছু চরিত্রের খুব অল্প সময়ের উপস্থিতি সেগুলোকে পূর্ণতা দিতে পারেনি। নন্দীনির চরিত্র হঠাৎ করে এসে দু-তিনটা সিনে দেখা গেলো, তারপর সজল কে চিঠি পাঠিয়ে ধরা পড়ার পর পরিণতি দেখানো হয়নি। 

ফেরদৌসের আশ্রয় দেয়া গ্রামের বাড়িতে রাজাকারের সহযোগিতায় যখন পাক আর্মিরা ঘেরাও করে ফেলেছে, তখন বাড়ির গৃহকর্তা তাকে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন এবং সাথে তার তরুণী মেয়েকে দিয়ে দেন। মেয়েটা নদী পার হতে গিয়ে অসুবিধা হবে বলে ফেরদৌসের কাপড় পরে, চিঠি লিখে ফেরদৌস কে দেয়, তারপর নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। সে কি সাঁতার জানে না বলে ঝাপিয়ে পড়েছিল? তাকে তো ফেরদৌস নিজের সাথেই পার করতে চেয়েছিলো। সাজু খাদেম এর রাজাকারের চরিত্র কোথায় হারিয়ে গেল? 

এমন টুকটাক কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়া ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সফল সিনেমাই বলা চলে। যারা ভালো সিনেমা হয় না বলে হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন না, তাদের হতাশ করবে না এই সিনেমা।

[email protected]

Share this news