
Published :
Updated :

স্পিরিচুয়াল টেস্টামেন্ট- ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের পুরনো এক পান্ডুলিপি। দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করা হতো, এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি উইলিয়াম শেক্সপিয়র-এর পিতা জন শেক্সপিয়রের গোপন ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রমাণ বহন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেল, ইতিহাসের সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নতুন বিশ্লেষণে প্রমাণ মিলেছে যে এই পাণ্ডুলিপিটি আসলে তাঁর অপেক্ষাকৃত অখ্যাত বোন জোয়ান শেক্সপিয়র হার্টের। এর ফলে প্রথমবারের মতো উন্মোচিত হলো ইংল্যান্ডের প্রারম্ভিক আধুনিক যুগের এক নারীর চাপা কণ্ঠস্বর।
সম্প্রতি শেক্সপিয়র কোয়ার্টারলিতে প্রকাশিত গবেষণায় ড. ম্যাথিউ স্টেগল, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক আধুনিক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক, এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, এতদিন যে দলিলটি জন শেক্সপিয়রের লেখা বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, সেটি আসলে তার মেয়ের লেখাযিনি ইতিহাসের পাতায় প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলেন।
রহস্যময় পাণ্ডুলিপি: 'স্পিরিচুয়াল টেস্টামেন্ট'
এই দলিলটি, স্পিরিচুয়াল টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত, ১৭৫৭ সালে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনের শেক্সপিয়র পরিবারের বাড়ি মেরামতের সময় পাওয়া যায়। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এটি জন শেক্সপিয়রের লেখা হিসেবে উদ্ধৃত হয়ে আসছিল এবং এলিজাবেথ প্রথমের শাসনামলে ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ ক্যাথলিক বিশ্বাস গোপনে লালন করার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হতো।
উন্নত ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ ও টেক্সট ডেটিং প্রমাণ করেছে, পাণ্ডুলিপিটি এমন সময়ে লেখা, যখন জন শেক্সপিয়র আর জীবিত ছিলেন না।
এই দলিলে পাওয়া গেছে ইল টেস্টামেন্তো দেল্ল’আনিমা নামের একটি ইতালীয় ধর্মীয় বই থেকে নেয়া অংশ, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৬০০ সালের প্রথম দিকে এবং ১৬০৩ সালের আগে এটি ইংল্যান্ডে পাওয়া যেত না। অথচ জন শেক্সপিয়র মারা যান ১৬০১ সালে। অর্থাৎ, বইটি তার জীবদ্দশায় ইংল্যান্ডে পৌঁছায়ইনি।
ড. স্টেগল পপুলার মেকানিক্স-এ বলেন, “যে উৎস থেকে এই লেখার অংশ নেয়া হয়েছে, সেটি তখন ইংল্যান্ডে ছিল না। সুতরাং জন শেক্সপিয়র লেখক হতে পারেন না।”
তখন দৃষ্টি যায় আরেকজনের দিকে। যিনি সেই বাড়িতেই বাস করতেন ১৭শ শতকের প্রথম দিকে, উইলিয়ামের বোন জোয়ান শেক্সপিয়র হার্ট। তিনি ১৬৪৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পারিবারিক বাড়িতেই ছিলেন। তার সম্পর্কে ইতিহাসে তথ্য অতি অল্প। মোটে মাত্র সাতটি সরকারি নথিতে তার নাম পাওয়া যায়, তাও কোনও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত ছাড়াই।
এক নারীর গোপন স্বর প্রকাশিত হলো
ড. স্টেগলের গবেষণা শুধু সময়কাল নির্ধারণেই থেমে থাকেনি। ভাষা ও গঠন বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, এটি নিছক প্রার্থনার সংকলন নয়—এখানে ব্যক্তিগত ভাবনা ও আত্মিক প্রতিফলনের ছাপ স্পষ্ট। লেখার ভঙ্গি কোমল, ভাবনাপ্রবণ এবং নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যা অনুলিপি নয়, বরং রচনার ইঙ্গিত দেয়।
একটি বিশেষ লাইন বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে লেখক ভার্জিন মেরি-কে আত্মার 'প্রিন্সিপাল এক্সিকিউটর' বা 'প্রধান নির্বাহক' বলে উল্লেখ করেছেন। সেসময়ের ইংল্যান্ডে কোনও নারী আইনগতভাবে ‘এক্সিকিউটর’ হতে পারতেন না তাই এটি এক ধরনের সাংকেতিক প্রতিবাদ।
ড. স্টেগল তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “এটি নিছক ভক্তিমূলক অনুলিপি নয়, এটি সৃষ্টিকর্ম, ভাবনাসমৃদ্ধ, সূক্ষ্মভাবে প্রতিবাদী এবং নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে রঞ্জিত।”
যদি তার বিশ্লেষণ সঠিক হয়, তাহলে জোয়ান হবেন শেক্সপিয়র পরিবারের প্রথম নারী লেখক, এবং সম্ভবত ইংল্যান্ডের প্রারম্ভিক আধুনিক যুগের অল্প কয়েকজন শ্রমজীবী নারী লেখকের একজন, যার লেখা আজও টিকে আছে।
এই আবিষ্কার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে—শেক্সপিয়র পরিবারের ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক পরিবেশ কেমন ছিল? এটি ইঙ্গিত দেয়, উইলিয়াম শেক্সপিয়র এমন এক ঘরে বড় হয়েছেন, যেখানে নারীরা কেবল পড়তে জানতেন না, বরং ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনা নিয়েও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।
নতুনভাবে লেখা হচ্ছে ধর্ম ও সাহিত্য ইতিহাস
এই আবিষ্কারের প্রভাব কেবল পারিবারিক ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ নয়। পপুলার মেকানিক্স-এর ভাষায়, জোয়ানের লেখকত্ব উইলিয়ামের বেড়ে ওঠা, তার চিন্তার উৎস ও পারিবারিক প্রেরণা নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোকেও চ্যালেঞ্জ জানায়। এটি যেন বাস্তব জবাব ভার্জিনিয়া উলফ-এর ১৯২৯ সালের বিখ্যাত প্রবন্ধ এ রুম অব ওয়ান’স ওন-এর প্রতি যেখানে উলফ কল্পনা করেছিলেন উইলিয়ামের এক কাল্পনিক বোন জুডিথ শেক্সপিয়রকে, যিনি প্রতিভাবান হলেও সমাজ তাকে লেখার সুযোগ দেয়নি।
mahmudnewaz939@gmail.com

For all latest news, follow The Financial Express Google News channel.