Bangla
2 years ago

৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস: যা কিছু জানা জরুরি

Published :

Updated :

থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল অসুখ। ঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা না করালে এটি মৃত্যুর কারন হতে পারে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় থ্যালাসেমিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। সারা বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু প্রতি বছর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রতি বছর ৮ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। 

জিনবাহিত একটি বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া। বংশপরম্পরায় একজন শিশু থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা-মা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে শিশু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। শরীরে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য প্রয়োজন হিমোগ্লোবিন। জিনগত ত্রুটির কারণে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরী হয়, যা রক্ত সংবহন করতে পারে না। ফলে দেহে রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। 

থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ 

হিমোগ্লোবিনে আলফা ও বিটা চেইন রয়েছে। এই দুটি চেইনের গঠনে কোনো ত্রুটি থাকলে থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে। কোন চেইনের গঠনে ত্রুটি রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায় - আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। এগুলো আবার দুই প্রকার হয়ে থাকে। আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং মাইনর। অপরটি হলো বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং মাইনর। 

হিমোগ্লোবিনের আলফা চেইন তৈরী হতে চার ধরনের জিন কাজ করে। যত বেশি চেইনে ত্রুটি থাকে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ তত বেশি তীব্র ও গুরুতর হয়। যেমন, একটি জিন আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো উপসর্গই দেখা যায় না। তবে তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়েই থাকবে সারাজীবন। 

অপরদিকে হিমোগ্লোবিনের বিটা চেইন তৈরী হয় দুইটি জিনের সাহায্যে। এই দুটি জিনের একটিতে বা দুটিতেই ত্রুটি থাকতে পারে। দুটি জিনই আক্রান্ত হলে তাকে বলা হয় বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর। 

থ্যালাসেমিয়া কার হয়

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। বাবা মা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া হতে পারে। মানবদেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া বা ৪৬ টি। একজন মানুষ যার অর্ধেক পায় মায়ের কাছে থেকে। অর্ধেক বাবার কাছে থেকে। বাবা মা দুইজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয় তবে শিশুর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি চারজন শিশুর মাঝে একজন থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হয়।

 চারজন শিশুর মাঝেই থ্যালাসেমিয়া জিন উপস্থিত এর মাঝে ৩ জনের শরীরে জিন প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। এবং একজনের মাঝে এই জিন প্রকট অবস্থায় থাকে। যাকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বলা হয়। এবং সব শিশুই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সাধারণত তেমন কোন উপসর্গ থাকে না। তবে সে তার পরবর্তী প্রজন্মে রোগ বহন করতে সক্ষম। 

যদি বাবা মায়ের মাঝে যে কোন একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বা বাহক হয়ে থাকে তাহলে তাদের ছেলে মেয়েরা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবে। তবে কেউই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে না। থ্যালাসেমিয়া জিন তাদের মাঝে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকবে। প্রকট অবস্থায় থাকবে না।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ

একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক জন্মের পর থেকে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই বেড়ে ওঠে। সাধারণত কোনো উপসর্গ পাওয়া যায় না। বাহ্যিকভাবে বোঝা না গেলেও মৃদু রক্তস্বল্পতা থাকতে পারে। 

আমাদের দেশে সাধারণত রক্তস্বল্পতার কারণ বা গর্ভাবস্থায় রক্ত পরীক্ষার সময় থ্যালাসেমিয়ার বাহক ধরা পরে। তবে থ্যালাসেমিয়ার রোগীর উপসর্গ শিশু অবস্থায়ই ধরা পরে। জন্মের পর থেকেই রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস হয়ে থাকে, প্লীহা ও যকৃত বড় হয়ে যায়, ঠিকমত শরীরের বৃদ্ধি হয়না। এছাড়াও দুর্বলতা, ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, খাদ্যে অরুচি, তন্দ্রা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ থেকে থাকে।

রক্তের রুটিন পরীক্ষা (সিবিসি) এর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সন্দেহ করা হতে পারে। হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সনাক্ত করা হয়ে থাকে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেও থ্যালাসেমিয়া সনাক্ত করা যায়। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা।

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়ার ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতায় অরগ্যান ফেইলিউর হতে পারে। যা জীবননাশ করতে পারে। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীর সময়মত সঠিক চিকিৎসা করতে হবে। 

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা হিসেবে মূলত ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়ে থাকে। ব্লাড ট্রান্সফিউশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বারবার করার ফলে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও হয়ে থাকে। এর ক্ষতিকর প্রভাব দেহে হৃদপিণ্ড, যকৃত, প্লীহার ওপরে পরে থাকে, রক্তে লৌহের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন চিলেশন থেরাপির প্রয়োজন হয়। বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। 

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ 

থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও থ্যালাসেমিয়া রোগী এক নয়। বাবা ও মা উভয়ের কাছে থেকে থ্যালাসেমিয়া জিন সন্তানের মাঝে আসলে সে থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হয়। বাবা মার মাঝে যেকোনো একজন থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক হলে সন্তান ও শুধু থ্যালাসেমিয়া বাহক হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হবে না। তাই বিয়ের আগে ও সন্তান ধারণের আগে নারী পুরুষের রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্ত পরীক্ষা করা এবং সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে সে অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

firuz.nawer@gmail.com

Share this news