Bangla
2 years ago

'আল্পনা আঁকি': সুমিতা হালদার

Published :

Updated :

বাঙালির নিজস্ব শিল্পমনের অভিব্যক্তি হলো আল্পনা। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ আর আল্পনা তার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এটি যেমন নিজে শুভ্র তেমনি শুভ্রতা ছড়ায় নান্দনিক মনে। তবে আজকের শহুরে ব্যস্ততায় আল্পনা একটু ম্লান হতে বসেছে। প্রাণরস সঞ্চারে কাজ করছেন নব্য শিল্পী সুমিতা হালদার। আল্পনাকে পৌঁছে দিচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সুমিতা হালদার পড়াশুনার পাশাপাশি অন্য ছাত্রছাত্রীদের মতন কিছু আয়ের জন্যে নানান অনুষ্ঠানে আল্পনা করেন। তিনি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মান্ডালা  আর আল্পনা আঁকার ব্লগের জন্য রীতিমতো জনপ্রিয়। বর্তমান প্রজন্ম এই ব্লগ দেখে এই মাধ্যমের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

মান্ডালা আর আল্পনা দুটোর জন্ম আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়াচ থেকে। আঁকতে গেলে মনে প্রশান্তি আনে। তবে ব্যক্তিগতভাবে শিল্পী সুমিতা হালদারের মান্ডালা আঁকা বেশি পছন্দের। সেই ভালোবাসা থেকে ফেসবুকে বেশ কিছু ভিডিও পোস্ট করেছেন, যেগুলি বেশ সাড়া ফেলেছে এবং নতুনদের আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছে। 

ছোটবেলা থেকে আল্পনা দেখে বড় হওয়া। যেকোনো উৎসব-পার্বণ পড়লেই আঙিনায় আল্পনা করতেন বড়রা। তাই দেখে প্রথমে একটা শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছে তারপরে করতে করতে ভালোবাসা। হিন্দু সংস্কৃতিতে অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন আল্পনা হয় না/ চারুকলাতে পড়তে গিয়ে অনুভব করলেন আল্পনা এখন নিরপেক্ষ শিল্পমাধ্যম। আল্পনা এখন হয় ভাষা দিবসে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে, বর্ষবরণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনীতে আর অফিসের নানান অনুষ্ঠানে। এই সব দিনে সবার সাথে কাজ করতে গিয়ে সুন্দর স্মৃতি অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি করছে।

সুমিতার করা বিয়ের আল্পনা। ছবিসত্ত্ব : সুমিতা হালদার

মানিকগঞ্জে কাটানো ছেলে বেলার দিনগুলিতে দেখেছেন পুজা-পার্বণে আল্পনা হতে। সেটাই যখন চারুকলায় টুকটাক শিখছেন, করতে থাকলেন বাড়ি বাড়ি। সেই কাজের ভিডিও যখন ফেসবুকে আপলোড করেন, তখন হঠাৎই তা ভাইরাল হয়ে যায়। জনপ্রিয় হতে থাকে সুমিতার আল্পনা। তখন থেকেই আল্পনাকে সুমিতা নিয়ে আসেন পেশাদারী পর্যায়ে। নতুন নতুন কাজ পাওয়া শুরু হয় বিভিন্ন অফিস আর বিয়ে বাড়ি থেকে। ঢাকাতে হরহামেশা ডাক পান; তিনি কাজ করেছেন পাবনা, চট্টগ্রাম সহ বেশ কিছু জায়গাতেও। আল্পনা আঁকতে গিয়ে এই যে ঘোরাঘুরি, এটিও বেশ জমিয়ে উপভোগ করেন সুমিতা। 

আল্পনার জন্ম হয়েছে বাংলার মায়েদের বোনেদের মন থেকে। আল্পনার আছে নিজস্ব প্রবাহমানতা যা তুলির টানে শিল্পীর মন হতে ক্রমশঃ প্রকাশ্যমান। যেখানে নিয়মের আতিশয্য নেই, আছে সৃষ্টি সুখের উল্লাস। তাই আল্পনা আঁকতে গিয়ে তেমন কিছু মাথায় রাখেন না সুমিতা, শুধু উপলক্ষটুকু ছাড়া। 

চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে একটু মাপজোঁক কাটেন বটে, তবে নিজেই জানালেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,"আমরা যে ছক বেঁধে আল্পনা করি, সেগুলি আসলে আল্পনা নয় তা শিল্পকর্মের পর্যায়ে চলে যায়। যা কাঁচা হাতে আঁকাবাঁকা করে আঁকা তাই বাস্তবে আল্পনা।" তাই এই ক্ষেত্রে শিল্পীমনকে স্বাধীন হতে হয়।

ফুল লতাপাতার নকশা কেটে আল্পনা করা সুমিতার বেশ পছন্দের, তবে গ্রাহকের আবদার রাখতে ভোলেন না। তাই তাদের পছন্দে কারোর ঘর সেজেছে জোড়া হাতি বা জোড়া ঘোড়াতে, কারোর মাছ দিয়ে আবার কারোর শুধুই ফুল পাতা আর কল্কাতে। সাধারণত আল্পনা শুধু মেঝে বা দেয়ালে দেখা গেলেও সুমিতা বলেন বর্তমানে এর ব্যবহার নানান মাধ্যমে যেমন জামা কাপড়, কুলো, পিঁড়ি কিংবা ঘর সাজাবার ওয়াল হ্যাংগিংয়ে। 

সাদা আল্পনা দেখে অভ্যস্ত হলেও সুমিতার পছন্দ রঙিন আল্পনা। তবে অনেক বেশি রঙ ব্যবহারের পক্ষে তিনি নন। সাদা, বাসন্তী আর লাল দিয়ে গোটা আল্পনা করে নিতে পারেন।

সুমিতা তার আল্পনার কাজে বিপুল সাড়া পেয়েছেন। তার কাছে সবচেয়ে যেটি ভালো লেগেছে তা হলো লোকের কাছে নতুন করে আল্পনার গ্রহণযোগ্যতা। সুমিতার আল্পনা আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বয়স্ক থেকে নতুন প্রজন্মের সবাই দেখছে। প্রজন্মে প্রজন্মে তিনি সেতুবন্ধ জুড়ছেন। এ থেকে মানুষ যে নতুন করে আল্পনার সাথে জুড়েছেন তাই সুমিতা হালদারের কাছে পরম পাওয়া।

এ যেনো হারাতেই বসে ছিল, পূজা-পার্বণে লোকে সস্তার স্টিকারে কাজ সেরে নিচ্ছিলো, কিন্তু সুমিতার ভিডিও গুলি তাদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করেছে বাঙালির শাশ্বত শিল্পে ফিরে আসতে। এই অনুসরণ করে দর্শকরা নিজেদের হাতে আল্পনা করে তারা আপন সংস্কৃতির প্রতি সেই ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াচ্ছেন সুমিতার অন্তর্জালের ডাকবাক্সে। 

সুমিতা বলেন  বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন আল্পনাও ততদিন ধরে আছে এই বাংলায়। কিন্তু নগরজীবনের ব্যস্ততায় মানুষ এর চর্চা ছেড়ে দিচ্ছে। তবে মনোগ্রাহী দিকটি মাথায় থাকতে হবে, আল্পনা গৃহে নব আবহ রচনা করে, মনে শান্তভাব ছড়ায়। আল্পনা টিকিয়ে রাখতে আয়োজন করা হচ্ছে নানান কর্মশালা, যেগুলি পরিচালনা করেন চারুকলার শিক্ষকেরা। এছাড়া তিনি মনে করেন, নতুন প্রজন্মে ছড়াতে শুরুটা হোক পরিবার থেকেই। বাড়ির বড়দের আল্পনা করার সময় ছোটদের ডাকা উচিত, তাতে তারা উৎসাহ পাবে। 

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৫ম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

roysushmitadiba@gmail.com

Share this news