Bangla
a day ago

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস: যেভাবে শুরু হয় এ দিন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর ক্যালেন্ডারে নিঃশব্দে হাজির হয় একটি দিন। দিবসটি এমন যা খুব কম মানুষ উদযাপন করে, খুব কম সংখ্যক মানুষ বোঝে, এবং অনেকে তো স্বীকার করতেই সংকোচ বোধ করে। বলছিলাম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের কথা যা নিয়ে কেউ শোরগোল করে না, যা স্লোগানে ভরা নয়, নেই কোনও প্রচারও।

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসকে অনেকেই আধুনিক কালের আবিষ্কার মনে করেন, কিন্তু ধারণাটি প্রায় তিন দশক পুরোনো। এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৯ সালে ড. জেরোম টিলাকসিংহ যিনি একজন ইতিহাসের অধ্যাপক।

পুরুষ দিবসের জন্য তিনি ১৯ নভেম্বরকে বেছে নেন। সেদিন তার বাবার জন্মদিন। বাবা তার জীবনে রোল মডেল ছিলেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে দিবসের তারিখ ১৭ নভেম্বর করেন। পুরুষর মানসিক স্বাস্থ্য, পিতৃত্ব, এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপ নিয়ে কথা বলা হোক এমনটা চেয়েছিলেন ড. জেরোম।

৬০ ও ৭০ এর দশকেও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনোটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়নি। ড. টিলাকসিংহ যখন দিনটি চালু করেন, তখন বিশ্ব ইতোমধ্যে পুরুষের সংগ্রাম নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস ৭০টির বেশি দেশে পালিত হয়। তবুও বেশিরভাগ মানুষ মিম বা সামান্য কোনও অনলাইন পোস্ট দেখে দিনটিকে মনে করে, তারপর আবার ভুলে যায়। কিন্তু এই দিনটির উদ্দেশ্য প্রচন্ড গভীর ও মানবিক।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পুরুষ একটি বাক্য শুনে বড় হয়েছে, “শক্ত হও।” কিন্তু সমাজে শক্ত হওয়ার অর্থ হয় নীরব থাকা। কাঁদলে বলা হয়, “এটা ছেলেদের মানায় না।”  প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নিজের সমস্যার কথা বলতে ভয় পায়, সে ভাবে যেন সেটা তার দুর্বলতা প্রকাশ।

তার ফলাফল? পৃথিবীর অনেক দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি। তারা থেরাপিতে যেতে দ্বিধাবোধ করে। অনেকেই বন্ধুর মাঝেও একা অনুভব করে। আর্থিকভাবে সফল না হলে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় একজন পুরুষের। পুরুষরা নিজের আবেগ প্রকাশ করতেও ভয় পান।

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পুরুষদের মহিমান্বিত করে না বরং তাদের মানবিকতাকে মনে করিয়ে দেয়। দিনটি বলে যে প্রতিটি বাবা, ভাই, স্বামী, বন্ধু, সহকর্মী এবং নিঃশব্দ পুরুষ মানুষটির ভেতর এক অদেখা আবেগের জগৎ আছে।

আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে পুরুষত্বের ধারণা দিনদিন বদলে যাচ্ছে। “শক্তিশালী ও নীরব” এই পুরোনো ছবিটি ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের পুরুষরা আবেগ, মানসিক স্বাস্থ্য, একাকীত্ব, ব্যর্থতা এসব বিষয়ে বেশ খোলামেলা। তবুও অনেকেই এখনও অন্যের দ্বারা সমালোচনা হওয়ার ভয়ে চুপ থাকে।

আধুনিক পুরুষ যেন এক দড়ির ওপর হাঁটছে। তাদের শক্ত হতে হবে, কিন্তু কোমলও হতে হবে। তাদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, কিন্তু অহংকারী হওয়া যাবে না। তাদের টাকা রোজগার করতে হবে, কিন্তু পরিবারেও সময় দিতে হবে। তাদের আবেগী হতে হবে, তবে “অতিরিক্ত” নয়। যা দিনশেষে ভারসাম্য বজায় রেখে পালন করা চারটেখানি কথা নয়।

তবে পুরুষ দিবসের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল পুরুষদের জন্য ইতিবাচক রোল মডেলদের তুলে ধরা।

এরা সুপারহিরো নয়। ধনকুবের নয়। নিখুঁতও নয়। এরা বাস্তব মানুষ। তারা হল দীর্ঘ পরিশ্রমের পরও সন্তানের হাসির জন্য বাড়ি ফেরা বাবা। পরিবারের জন্য নীরবে লড়াই করা ভাই। ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করা শিক্ষক। এমন এক তরুণ, যে জীবনে ঠিক কোন পথে যাবে বুঝতে পারছে না, তবুও হাল ছাড়ছে না। এ দিনটি আমাদের বলে যে পুরুষত্ব মানে আধিপত্য নয় বরং দায়িত্ব, সহমর্মিতা, সাহস এবং উন্নতি।

বর্তমানে অনেকেই পুরুষ দিবসকে তুচ্ছ করে, বলে যে পুরুষদের আদৌ বিশেষ দিনের দরকার আছে নাকি? কিন্তু এই দিনটি ক্ষমতা বা সুবিধা নিয়ে নয় বা কতৃত্ব নিয়ে নয়। এই দিনটি স্বাস্থ্য নিয়ে, মানসিকতা নিয়ে, মানবতা নিয়ে।

পুরুষ দিবস পুরুষদের সংগ্রামকে তুলে ধরে কিন্তু নারীর সংগ্রামকে অস্বীকার করে না বরং নারীর পাশে দাঁড়ায়। সুস্থ একটি সমাজ গড়তে হলে নারী-পুরুষ উভয়েরই মানসিকভাবে সুস্থ, সমর্থিত ও বোঝাপড়া রয়েছে এমন পরিবেশ দরকার।

সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কোনও নিখুঁত পুরুষের উদযাপন নয়। এটি সব ধরনের পুরুষের জন্য আমন্ত্রণ। তাদের একটু খানি থামার, ভাবার, বিশ্রাম নেয়ার, নিঃশ্বাস নেয়ার দিন।

যেসব পুরুষ ক্লান্ত তবু থামে না তাদের বলা যে আমরা আপনার পাশে আছি। যারা সবাইকে আগলে রাখে, কিন্তু রাতে নীরবে ভেঙে পড়ে, তাদের বলা যে, আপনি গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব তরুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা তাদের বলা যে, আপনি একা নন। যেসব বাবা কাজ, ভালোবাসা ও দায়িত্বের সমন্বয় করেন, তাদের বলা যে আপনাকে মূল্যায়ন করা হয়। আর যেসব পুরুষ মনে করেন তাঁর কষ্টগুলো ছোট তাদের বলা যে সেগুলো ছোট নয়।

তবে আশার নতুন পথও খুলছে, ধীরে ধীরে পৃথিবী বদলাচ্ছে। পুরুষরা এখন কথা বলছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। থেরাপি নিয়ে কম ট্যাবু হচ্ছে। ছোট ছেলেদের শেখানো হচ্ছে যে কান্নাও সাহস। হয়তো এটিই আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের আসল উদ্দেশ্য।

samiulhaquesami366@gmail.com

Share this news