Bangla
a year ago

বাংলাদেশে যেমন হয় বড়দিন উদযাপন

Published :

Updated :

বছরের শেষ, পৌষী শীতের শীতল ছোঁয়া। তাই বলে থেমে নেই উষ্ণতার উৎসব। সবার মাঝে উত্তাপ ছড়াতে এই তেরো পার্বণের দেশে আমাদের জাদুর শহরটাতে আপন রঙে পালিত হয় যীশুর জন্মোৎসব ক্রিস্টমাস বা বড়দিন। 

পঁচিশে ডিসেম্বরের বৈশ্বিক এই উৎসব আমাজে পিছিয়ে থাকে না ঢাকাবাসী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছোট-বড় সবার মাঝে খুশির জোয়ার, ধর্মীয় উৎসব বলে নয়, একাত্বতার উৎসব বলে। 

শহরটাও সেজে ওঠে নতুন লেবাসে। রাস্তায়, ক্যাফেতে, রেস্টুরেন্টে, শিশুপার্কে, শপিং মলে, হোটেলে জমকালো বড়দিনের সাজ- রং-বেরঙের আলো, বিশাল ফার গাছের আলোক তরু আর সান্তা ক্লজের উপহার কর্ণার। শীতের মাঝে একটা দারুন উৎসবের আমেজ। শহরজুড়ে খুশির উৎসব বড়দিন।

মসীহ যীশুর জন্মদিনকে কেন বাঙালি বড়দিন বলে তাই নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। বাংলা একাডেমির মতে, ২৩ ডিসেম্বর উত্তর গোলার্ধে হ্রস্বতম দিন। তার পরের দিন থেকেই উত্তরায়ণের শুরু, সেই সঙ্গেই শুরু দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি। পঁচিশে ডিসেম্বর তাই যথার্থই বড়দিন, বৎসরের সবচেয়ে ছোট দিনটির থেকে। গবেষকরা মনে করেন এই দেশে নতুন ধর্মে দীক্ষিত সম্প্রদায় মনে করতো তারা নবজীবন লাভ করেছে এবং যীশুই তাদের ত্রাতা, তাই ত্রাতার জন্মদিন তার সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন, তাই বড় দিন।

"বড়দিন মানে অনেক স্মৃতির উৎসব, নস্টালজিয়া। বড়দিন মানে সবার একত্ব হওয়া। পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুরা মিলে গির্জায় যাওয়া, দেশ ও দশের জন্যে প্রার্থনা করা। যীশুর বাণী পরস্পরকে ভালোবাসা। বড়দিন যেন তাই ভালোবাসা আর নস্টালজিয়ায় সমৃদ্ধ সুহৃদবন্ধন, যেখানে ধর্ম বর্ণ বা বিশ্বাসের বাঁধা নেই, আছে সকলের একত্ব, সকলে মিলে একসাথে প্রীতিভোজ আর হই-হুল্লোড়," বলছিলেন নব্য চিকিৎসক ডা. প্রীতিলতা মেরী ত্রিপুরা। স্মৃতিচারণ করছিলেন শৈশবের। ছোটবেলায় বড়দিন মানে ছিল বেশি বেশি আবদারের দিন, অনেক অনেক উপহার, অনেক মজা আর ভাইবোন সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া। 

বড়দিনের উপহার নিয়েছিল আলাদা রকমের জল্পনা। উপহারটা সান্তা ক্লজ কেমন করে কখন দিয়ে যাবে। বড় হয়ে বুঝেছেন আসলে তার গৃহের সান্তা হলেন তার মা নিজে, তিনি নিজেই বুঝে নিতেন আর সন্তানের আকাঙ্খিত বস্তুটি সুন্দর করে সাজিয়ে সান্তার নাম করে হাতে তুলে দিতেন। সেই সময়ের এই স্মৃতিগুলো সারাজীবন নস্টালজিয়া জাগাবে। 

এখন সময় পাল্টেছে বয়সটাও বেড়েছে। এখন বড়দিন হলো উৎসবের দায়িত্বভার বন্টন করে নানান কাজে হাত লাগানো। বড়দের চালিয়ে ঐতিহ্যকে ধরে রাখা আর পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়া। 

সত্যি বলতে শিশুদের বড়দিনের আনন্দ যেন কয়েকগুণ বেশি। বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে তারা বড়দের তো সাহায্য করেই সাথে নিজেরাও হাতে সবুজ কাগজ আর তুলো দিয়ে তুষার জড়ানো গাছ মানায়। ফ্রিজের জমানো বরফ দিয়ে বা মাটি দিয়ে বানিয়ে ফেলে তুষারমানব। আর হাঁটু গুঁজে অপেক্ষা করে কখন সান্তা ক্লজ ঘরে ঝোলানো রংবেরঙের মোজাগুলিতে তাদের চাওয়া উপহারগুলি ভরে দিয়ে পালিয়ে যাবে।

 ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গাঢ় করতে চলে হাতে গড়া কার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময়। 

প্রীতিলতার শেকড় পাহাড়ের দেশ বান্দরবানে। তিনি জানালেন ঢাকার হই-হুল্লোড় অনেকখানি যেন বদ্ধ নিশ্চুপ বান্দরবানের তুলনায়। সেখানে উৎসবটি বেশ প্রাণবন্ত। পাহাড়ি অধিবাসীরা উৎসবের দিনটি সারারাত জেগে থেকে উদযাপন করে, বাড়ি বাড়ি কীর্তন গান আর দক্ষিণা তোলা হয়, প্রকৃতির কোলে খুব যেন একটা সরব পরিবেশ থাকে। তবে বহুকালের অভ্যাসে ব্যস্ততম শহরের আয়োজনটাতেই আজকাল বেশি মানিয়ে গেছেন। 

বড়দিনের সাজসজ্জা

ডিসেম্বরের শুরু থেকে আরম্ভ হয় প্রস্তুতি। ঘর সাজানোর নানান বস্তু, নতুন পোশাক, নানান রকমের খাবারের জিনিস। মাসের শুরু থেকেই উৎসব। যাদের বাড়িতে বড়দিন পালন হয়, তারা ঘর পরিষ্কার আর গোছগাছে লেগে পড়েন। বাড়ি সাজানো হয় নানান রকম আলো দিয়ে আর হরেক রকম শীতের ফুলে।

ডাক্তার প্রীতিলতা তার ছোটবেলার কথা বলেন, তার নানা সেসময় কাগজ কেটে কেটে নানান ডিজাইনের ঝালর, ফুল-পাতা, কাগজের ভাঁজে অনেক রকম অরিগ্যামি গড়তেন। ওই দিয়েই ঘর সাজানো হতো।

বড়দিনের সবচেয়ে মূল আকর্ষণ একটা লম্বা ফার গাছ বা পাইন গাছ বা ওই ধরনের যেকোনো গাছকে ছোট ছোট পুতুল, ঘন্টা, চকলেট, নানান রকমের আলোকবাতি, তুষারখন্ড, ক্যান্ডি, জিঞ্জারব্রেড, নকশি মোজা আর পবিত্র পাতা দিয়ে সাজিয়ে খ্রিস্টমাসের আলোকতরু বানানো।

প্রত্যেকের বাড়িতে যখন এই আয়োজনটা সম্পন্ন হয় তখনই যেন মনে খ্রিস্টমাস ঘরের দুয়ারে। এছাড়াও সাজানো হয় যীশুর আবির্ভাব ভূমি গোশালার ছোট্ট সংস্করণ। মেষেদের মাঝে মা মেরির কোলে ছোট্ট যীশু। একে বলা হয় ক্রিস্টমাস ক্রিব। 

বড়দিনের দু-একদিন আগে থেকে বাড়িতে বাড়িতে তৈরি চলে নানান রকমের কেক আর কুকি তৈরি। বাদ যায় না দেশীয় পিঠা তৈরিও। কেকের ভেতর থেকে চকলেট কেক, ফলের কেক, পুডিং আর মিন্স পাই। কুকি গুলি কাটা হয় নানান উৎসবসামগ্রীর প্রতীকের মতন করে। কেকের সাজেও খ্রিস্টমাসের আবহ তৈরি করা হয়। 

বড়দিন প্রাক-সন্ধ্যা

বড়দিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় আগের দিন থেকে, যাকে বলে ক্রিস্টমাস ইভ বা বড়দিনের প্রাক সন্ধ্যা। এইদিন ফাস্টিং করা হয় সূর্যাস্তের পরে। সন্ধ্যায় গির্জায় শুরু হয় প্রার্থনা। তারপরেই ক্যারল বা ঈশ্বরের কীর্তন। সমবেতরা প্রভুর কাছে মনের আকুতি জানান এবং সকলের জন্য শান্তি কামনা করেন। 

বড়দিন 

সকাল থেকেই উৎসব মুখর পরিবেশ আর গণ জমায়েত। ‘জিঙ্গেল বেলের’ সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। গির্জায় ধূপ-ধুনোতে স্বর্গীয় পরিবেশ রচিত হয়। যীশুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় নানান অর্ঘ্য। পবিত্র বাইবেল থেকে পঠিত হয় ঐশী বাণী। ফাদার জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ধর্মকথা আলোচনা করেন।

সমবেত শ্রদ্ধাবানদের উপাসনা, প্রার্থনা সঙ্গীত এরপরেই আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে ভিড়। যেই এলাকাতে নেই গির্জা, সেখানে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ একজনকে গুরুজন মেনে তার বাড়িতেই হয় সকল আয়োজন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব শ্রেণী পেশার মানুষ সেই বাড়িতেই জড়ো হোন, উপহার বিতরণ করে একে অপরের সাথে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। 

ভোজ আয়োজন

বড়দিনের প্রীতিভোজে কেক, কুকি, নানান ফলের পানীয় ছাড়াও থাকে দেশীয় আয়োজনের সেমাই, মিষ্টি, ফিরনি, কোরমা-পোলাও। কারো কারো বাড়িয়ে আস্ত মাংস বেক করা হয়। তবে দেশীয় খাবারের সম্ভারই বেশি থাকে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব সাড়া হয়ে গেলেই সবাই যার যার মতোন এদিক ওদিক ঘুরতে বের হোন সঙ্গীদের সাথে।

উৎসব আয়োজনে গির্জাগুলো

ঢাকার ছোট বড় সব গির্জাতেই চলে নানান ধর্মীয় আচার, প্রার্থনা আর উৎসব-অনুষ্ঠান। দুস্থদের সাহায্য ও খাবার বিতরণ করা হয়। ঢাকার গির্জাগুলোর মাঝে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রাল, তেজগাঁওয়ের জপমালা গির্জা, লক্ষ্মীবাজারের পবিত্র ক্রুশ গির্জা, আসাদ গেটের সাধ্বী ক্রিস্টিনার গির্জা, মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, ভাটারার ঐশ করুণা গির্জা, মহাখালীর লুর্ডের বাণী গির্জা আর বারিধারার ডি ম্যাজেনেড গির্জা।

বড়দিন আসা মানেই নতুন বছরের সূচনা, তাই গির্জার আনুষ্ঠানিকতা নতুন বছরের আগমন পর্যন্ত চলতে থাকে। 

roysushmitadiba@gmail.com 

Share this news