Bangla
2 years ago

বিপ্লবীদের চা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, রিকশাচালক - সবাই চা খায় এখানে

ইয়াসিন স্বপন (বামে) ও বিপ্নবীদের চা-র ভেতর বাহির, ছবি:  লেখক 
ইয়াসিন স্বপন (বামে) ও বিপ্নবীদের চা-র ভেতর বাহির, ছবি:  লেখক 

Published :

Updated :

শান্তিনগর মোড় থেকে রাস্তা পেরিয়ে অপরপাশে গেলে ঢাকা গ্যাস্ট্রো-লিভার সেন্টার এর কিছুটা বামে গেলে একটু খোঁজাখুঁজির পরই পেয়ে যাবেন একটি চা দোকান উপরে লেখা বিপ্লবীদের চা সেখানে চা তৈরি করছেন লম্বা চুলের শ্যামলা একজন মানুষ 

চা অর্ডার করলেই যে সবাইকে চা দিচ্ছেন এমন নয় কাউকে কাউকে বলছেন চা নেই কাউকে কাউকে দিচ্ছেন চা এতে কিছুটা অবাকই হতে হলো 

তার সঙ্গে শুরু হলো আলাপচারিতা তাকে ছাপিয়ে চোখে পড়লো দেয়ালে টানানো তিনটে ছবি ফিদেল কাস্ত্রো, লেনিন চে গুয়েভারা ঝুলিয়ে রাখা কফি সরিয়ে দেখালেন মার্কস এঙ্গেলসকেও

চা বিক্রেতার নাম ইয়াসিন স্বপন জন্ম ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় হলেও নিজের দেশের বাড়ি 'নেইবলছিলেন! কেনো নেই? কারণ, জীবনের জন্য শিশুকালেই পথকে করে নিতে হয়েছিলো নিজের ঠিকানা 

স্বপন চা বানানো শিখেছিলেন মাত্র সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সাল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ছিলেন ভারতে এরপর দেশ স্বাধীন হলো তারা সপরিবার ফিরেও এলেন তারপর পারিবারিক কিছু কারণে ঘর ছেড়ে তিনি আসেন ঢাকায় 

সময়টা ১৯৭৪ সাল দুর্ভিক্ষের সময় তাদের পরিবারে নেমে আসে তীব্র সংকট স্বপনের বয়স তখন ১০ বছর ঢাকা আসেন এরপর আগরতলা হয়ে যান ভারতে সেখান থেকে পাকিস্তানে পরে আবার ঢাকা 

জীবনে বহু কিছু করেছেন কাগজ টোকানো, রিকশা চালানো, ভ্যান চালানো, রেল লাইনে কাজ, ইত্যাদি চা দোকান দেন ২০০৬ সালে তখন নাম ছিল টি২১ তাদের দোকান মালিক টিটু সাহেবের নাম থেকে নামটি নেয়া এরপর সময় চলে যেতে থাকে ২০১৭ সালের দিকে ব্যক্তিগত একটি ঝামেলার কারণে দোকানের আগের নাম রাখা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে তাই নতুন নাম দেন 'বিপ্লবীদের চা

কিন্তু এত নাম থাকতে এরকম নাম কেন? এর উত্তরে ইয়াসিন স্বপন বললেন, "আমি নিজে একজন শোষিত - নিপীড়িত মানুষ দোকানের আগের নাম যখন ছিলো, তখনও দোকানের ওয়ান টাইম কাপে কাস্তের ছবি প্রিন্ট করা ছিলো আমি নিজে শোষিত মানুষ, তাই দোকানের এমন নাম দেওয়া।” 

তার দোকানের বিশেষত্ব, তিনি প্রতিদিন ৩০০ কাপের বেশি চা বিক্রি করেন না একেবারে নতুন কোনো কাস্টমারের জন্য সুযোগ আছে, চা খেয়ে তারপর টাকা দেয়ার কিন্তু দ্বিতীয়বার থেকে আগে টাকা দিয়ে তারপর চা নিতে হয় কেউ প্রথমদিন টাকা না দিলে দ্বিতীয়দিন থেকে তাকে আর চা দেন না এক্ষেত্রে তার অবস্থান খুব স্পষ্ট 

তার কথায়, " আমি এক্ষেত্রে আমার মেধা, শ্রম দিই তাই চা নিতে গেলে অর্থ দিতে হবে এখানে বড় রাজনীতিবিদ, পুলিশ, আইনজীবী, রিকশাচালক, ছাত্র, ড্রাইভার- সবাই চা খায় সবাইকে একই কাপে চা দেয়া হয় টাকাও সবাইকে আগে পরিশোধ করতে হয় এক্ষেত্রে আলাদাভাবে কারো ক্ষমতা দেখানোর কিছু নাই এই জায়গাতে সবাই সমান

তার দোকানে মাঝে মাঝে চা খেতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক . আবদুর রাজ্জাক খান তার সঙ্গে বিবিধ বিষয়ে আলাপ হয় ইয়াসিন স্বপনের 

তিনি জানান, "আমি তো স্বশিক্ষিত মানুষ স্যার এখানে বসেন, কথাবার্তা বলেন তিনি আমাকে বিভিন্ন বই পড়তে দিয়েছেন যেমন - দ্য ফিফথ ফ্লেম সফদার হাশমির ওপর লেখা ওনার বোন লিখেছেন আমি স্যারের পরামর্শে ট্রেন টু পাকিস্তান পড়েছি যেকোনো বই আমাকে কেউ পড়ার জন্য বললে আমি পড়ি কোনো বইয়ে আমার আপত্তি নাই

কবিতা শুনতে পড়তে খুব পছন্দ করেন স্বপন বেশি পড়া হয় নজরুলের কবিতা আবৃত্তি শোনেন ফয়সাল আজিজের 

তিনি মনে করেন, শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা দেয় সমাজতন্ত্র আর চা দোকানগুলো হলো উন্মুক্ত প্লাটফর্ম সাধারণ মানুষের সংসদ এখানে বিভিন্ন রকমের মানুষ আসবে, নানারকম ব্যাপারে খোলাখুলি আলাপ হবে আর অবশ্যই- সবাইকে চায়ের বিল মেটাতে হবে তার বিবেচনায়, সবাই টাকা দিয়ে একই ধরনের কাপে চা খাবে- এটাও একরকম বিপ্লব তিনি এমন আরো চা দোকান সম্ভব হলে প্রতিটা জেলাতে করতে চান 

তার কথায়, " কোনো কমরেড যদি আমাকে বলেন, এমন দোকান করবেন আমি সহায়তা করবো এমন দোকান আরো হলে সবাই টাকা পরিশোধ করেই চা খাবে যারা মানুষের মুক্তি চান, তেমন মানুষগুলো একসঙ্গে বসবেন, আলোচনা করবেন

এদেশিয় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির গণবিচ্ছিন্নতা নিয়ে বললেন, "বাম নেতারা যদি এটা নিশ্চিত করতে পারে যে, ঢাকা শহরের সব রিকশাওয়ালারা  তাদের সাথে আছে, তাহলে বিপ্লব সম্ভব ব্যক্তিগত বিলাস, আয়েশ ছেড়ে তাদের জনতার কাতারে নেমে যাওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গে আসে শহিদ কমরেড তাজুল ইসলামের কথা স্বপন পেছনে দাঁড়ানো এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, " ইনি কমরেড তাজুলের ভাই

তার নাম জাকির হোসেন এদিকে থাকেন না তবে রমনা থেকে এসেছেন এক বন্ধুর সঙ্গে এখানে মাঝে মাঝে চা খাওয়া হয় তিনি জানান, "অনেকেই চা বিক্রি করেন কিন্তু এখানে চা বিক্রি করা হয় সমাজ পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে এই ব্যাপারটা দোকানটাকে অন্যান্য চা দোকানের চেয়ে আলাদা করেছে

এদিন এখানে এসেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা মাইন উদ্দিন জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনিতিনি করছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিচারণ মালিবাগে থাকেন, প্রায়ই আসেন স্বপনের সঙ্গে তার রাজনৈতিক দর্শনে পার্থক্য আছে তবে চা খেতে খেতে হয় সুস্থ আলোচনা ভিন্ন মতের নানা মানুষের সহাবস্থান- এমনটি মনে করেন তিনি  পরে একজন পুলিশ সদস্যও চা খেতে খেতে বললেন এমন নানা কথা 

এর ভেতর সেই ৩০০ কাপ চা বিক্রি শেষ সকাল আটটা থেকে দোকানে থাকেন স্বপন ৩০০ কাপ পুরোলেই বিক্রি বন্ধ তার কথায়, "স্বার্থপর মানুষদের চা দিই না আমি যারা শ্রমের মূল্য দেয়না, মর্যাদা বোঝেনা তাদের জন্য নয় এই চা কমরেডের ওপর আস্তা রাখতে হবে একদিন চা খেলেই বুঝবেন, আমার চা খাঁটি দুধের কোনো ভেজাল নাই আর তাই দ্বিতীয় দিন থেকে দাম আগে দিতে হবে সেইসঙ্গে চা ভালো হবে তো বা ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে ধরনের সংশয় মনে রাখা চলবে না এখানে আপনাকে তেমন চা দেয়া হবেনা

সে সময় সেখানে ছিলেন একজন ড্রাইভার তিনি বললেন, "এখানে মনে করেন, যে জায়গায় ঢাকা ভার্সিটির স্যার বসে, এমপি ক্যান্ডিডেট বসে বা পুলিশ অফিসার বসে; আমিও সেই জায়গায় বসে চা খেতে পারছি এজন্যই দোকানটার চা বিপ্লবীদের চা

 mahmudnewaz939@gmail.com 

Share this news