Bangla
2 years ago

বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমায় কবিগুরুর শান্তিনিকেতন

 শান্তিনিকেতন গৃহ 
 শান্তিনিকেতন গৃহ 

Published :

Updated :

আপামর বাঙালি শান্তির সন্ধানে জীবনে একটিবার হলেও পা ফেলে রবিতীর্থ শান্তিনিকেতনে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ লালিত শিক্ষাভূমি শান্তিনিকেতন, একটি বিদ্যায়তনকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট্ট জনপদ সম্প্রতি পেলো ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য তকমা। 

গত ১৭ ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ৪৫ তম অধিবেশনে এই আনন্দ সংবাদ এই মর্মে ঘোষণা করে যে, শান্তিনিকেতন মানবতার ঐক্য এবং বিশ্বভারতী বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি।

এই বিশ্ব সংস্থার বিচারে শান্তিনিকেতন ২০ শতকের প্রাক্কালের ব্রিটিশ উপনিবেশিক স্থাপত্যের দিক থেকে ভিন্ন এবং তা ইউরোপীয় ভাবধারার আধুনিকতাবাদ ব্যতিরেকে প্যান-এশীয় আধুনিকতার সাথে এই অঞ্চলের নিজস্ব প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় লোক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। 

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কবিগুরু 

বীরভূমের বোলপুরের শান্তিনিকেতন প্রথমে ছিল ঠাকুর পরিবারের গড়া ভারতাত্মার তপভূমি। ব্রাহ্ম মতাদর্শে বিশ্বাসী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংসার হতে নিভৃতে তপস্যা করতে এই স্থানটিকে চয়ন করেছিলেন। 

এই অঞ্চলের পূর্ব নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা যা তিনি ১৮৬৩ সালে স্থানীয় রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছে ইজারায় ক্রয় করেছিলেন। তিনি সব সময় চাইতেন এখানে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় হোক। পরবর্তীতে তার সুযোগ্য পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে মাত্র পাঁচজন শিষ্য নিয়ে নিয়ে সেই বিদ্যানিকেতনের যাত্রা আরম্ভ হয়।

রবীন্দ্রনাথ চাইতেন ইউরোপীয় শিক্ষার আরোপিত কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এমন এক শাশ্বত শিক্ষা ব্যবস্থা চর্চিত হবে যেখানে বিদ্যা দাস নয়, বরং স্বাবলম্বী মানুষ তৈরি করবে এবং তা আপনাই শিক্ষার্থীর আত্মস্থ হবে। সেই ভাবনা থেকেই অনেক টানাপোড়েন সহ্য করেও দেনায় জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ পত্নী মৃণালিনীর গয়না বন্ধক রেখে ১৯০১ সালে গোড়াপত্তন করেছিলেন এক ব্রহ্মচর্যাশ্রমের। মাত্র পাঁচজন শিষ্য আর এক আচার্য নিয়ে শুরু। সেই ছিল শুরু আজকের শান্তিনিকেতনের। এরপরে ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যা রবীন্দ্র স্বপ্নজাত শিক্ষাপদ্ধতির বিজয়কেতন এবং আজকের দিনের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। 

রবীন্দ্রনাথের পরেই এই স্থান যাদের পরশ পেয়ে আরো বিকশিত হয়েছে তারা হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরোজিনী নাইডু, ক্ষিতিমোহন সেন, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু সহ আরো অনেকে। সেই বিশ্বভারতীর আজকের অঙ্গসংগঠনগুলো হলো পাঠভবন, শিক্ষাভবন, বিদ্যাভবন, কলাভবন, সঙ্গীতভবন ও গ্রন্থন। 

এই আদর্শ শিক্ষায়তন আপন মহিমাতেই প্রজ্জ্বল, তাকে উপরে উঠতে আলাদা কোনো কৃতি বা সম্মানের প্রয়োজন হয় না। তবুও ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি সত্যিই আনন্দের ঢেউ এনেছে সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য। বিশ্বসংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সকল অলংকৃত হয়ে শান্তিনিকেতন বেড়ে উঠেছিল নিভৃত তপস্থল হয়ে, যেখানে একটি জাতি আপন অস্তিত্বের সন্ধান পায়। মহাত্মা গান্ধী এখানে এসে মন্তব্য করেছিলেন, "শান্তিনিকেতনই সমগ্র ভারত"। 

রঙিন কাঁচে নির্মিত উপাসনা গৃহ 

শান্তিনিকেতনের মূল ভবন শান্তিনিকেতন গৃহ, যেটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির আদলে মহর্ষি নির্মাণ করিয়েছিলেন অতিথিদের জন্যে। তিনি নিজে আসলেও এখানেই থাকতেন। এখন এর সামনে রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি 'অনলশিখা ভাস্কর্য' শোভা পাচ্ছে। 

একটু কাছেই ছাতিমতলা। রায়পুর জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে এখানে এক ছাতিম গাছের তলায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহর্ষি, তিনি তখন অপার্থিব শান্তি লাভ করেছিলেন। সেই ছাতিম গাছ আজ আর নেই তবে সেই স্থানে হয়েছে এক বেদি, তাতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা - তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।

এখানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা উপাসনাগৃহ, যেটি সম্পূর্ণ রঙিন কাঁচে দিয়ে তৈরি। এর নির্মাতাও রবির পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল লন্ডনের হাইড পার্কের দ্য ক্রিস্টাল প্যালেসের আদলে। কাঁচমন্দিরে এখনো যেকোনো বিশ্বাসের লোক প্রবেশ করতে পারে, তবে তাকে প্রবেশ করতে হবে মার্জিত সাদা পোশাক পড়ে, এটি কঠোর ভাবে অনুসৃত হয় এখানে। 

আছে কবির শখের তিনপাহাড়ের বট, এই গাছটিকেই সহজপাঠের প্রচ্ছদে দেখতে পাওয়া যায়। মনে পড়ে কবিতাটি- 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে'। আসলে কবি এই কবিতা লিখেছিলেন তালধ্বজকে দেখে। তালধ্বজ একটি মাটির বাড়ি যার ঠিক মাঝ বরাবর ছাদ ফুঁড়ে উঠেছে এক মস্ত তালগাছ। 

সিংহসদন 

আছে সিংহসদন, সামনে বিরাট মাঠ যার নাম গৌড়প্রাঙ্গণ। একটু দূরে ঘন্টাতলা, যেটি সাঁচি স্তূপের আদলে তৈরি। এর ঘন্টাধ্বনি শুনেই পাঠের শুরু আর ছুটি। তারপরে রাশি রাশি বকুলের গন্ধে আমোদিত বকুলবীথি। 

আছে বিশাল আম্রকুঞ্জ যেখানে উদযাপিত হয়েছে কবির জন্মোৎসবগুলি। কবির নোবেল প্রাপ্তির সংবর্ধনা আয়োজনটিও এখানেই। আম্রকুঞ্জের দক্ষিণকোণে একটি বাড়ি, নাম দেহলি। কবি তার পত্নী মৃণালিনীর সাথে এখানে থাকতেন। 

এছাড়া আছে পঞ্চবটী ঘেরা বাড়ি উত্তরায়ণ, আর অন্যান্য বাড়ি উদীচী, কোণার্ক, উদয়ন, শ্যামলী আর পুনশ্চ। আছে সারি সারি কালোবাড়ি, যেগুলি সব মাটির বাড়ি যার গাঁয়ে মাটি দিয়ে নানা রকম নকশা করা যা রক্ষিত  হচ্ছে আলকাতরার প্রলেপ মেখে। এছাড়া অন্যান্য ভবনের ভেতর আছে নিপ্পন ভবন, চীনা ভবন, চিত্রভানু গুহাঘর, মুকুটঘর।কবির ব্যবহৃত নানা জিনিসের সম্ভার নিয়ে আছে বিচিত্রা নামের সংগ্রহশালা। শান্তিনিকেতনের অন্যতম আকর্ষণ সোনাঝুরির বনে বসা হাট যেখানটায় বিকিকিনি চলে নানান শিল্পসামগ্রীর। 

অজয় নদ আর কোপাই নদীর কোলে অবস্থিত শান্তির এই নিকেতন আপন আচার আর উৎসব অনুষ্ঠানে অনন্য হয়ে আজ বিশ্ব সংস্কৃতির বুকে জ্বলজ্বল করছে। আপন রসে-গন্ধে-রূপে শান্তিনিকেতনকে সাজিয়ে এখানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কবিগুরুর সময় হতেই পালন করে আসছে নানা উৎসব-পার্বণ।

বছরের শুরু হয় বর্ষবরণ দিয়ে। এরপরেই রবীন্দ্রজন্মোৎসব। ধর্মচক্র প্রবর্তনে স্মরিত হন তথাগত বুদ্ধ। বর্ষামঙ্গলে গীত হয় বর্ষার রাগ, বনমহোৎসবে রোপিত হয় নানান বৃক্ষ। কবিগুরু নিজেই নানান জায়গা থেকে দুর্লভ সব বৃক্ষ সংগ্রহ এখানে রোপন করেছিলেন। তাকে স্মরণ করেই তার প্রয়াণ দিবসে তা পালিত হয়। শান্তিনিকেতন প্রাঙ্গণ আজ অলংকৃত দুর্লভ সব বৃক্ষের ছায়ায়। 

ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে রাখীউৎসব, নাট্য মঞ্চায়নে শারদ উৎসব, ব্রহ্মোপসনায় পৌষ উৎসব, খৃষ্টের জন্মদিনে খ্রীষ্টোৎসব, ফুলে আর রঙে মন মাতানো বসন্তোৎসব - এইভাবেই মেতে থাকে শান্তিনিকেতন বছর জুড়ে। আর প্রত্যেক উৎসবে অঙ্গন সেজে ওঠে নিজস্ব শান্তিনিকেতনী আল্পনায় আর ছেলে মেয়েরা সাজের বাহারি কারুকাজের ফুল-পাতার গহনাতে। 

বিশ্বঐতিহ্যের তকমাকে টিকিয়ে রাখতে শান্তিনিকেতনের রক্ষণকর্তাদের মেনে চলতে হবে কিছু বিধি। যা যেমনি ছিল, যেমন রয়েছে, তেমন ভাবেই টিকিয়ে রাখতে হবে। জানলা-দরজা থেকে শুরু করে সবকিছুই মেরামত করতে হলেও আনা যাবে না কোনো বদল। নকশার তো নয়ই, যা দিয়ে তৈরি সেটি রাখতে হবে; কোনো পরিবর্তন চলবে না। 

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, “একবিংশ শতাব্দীর স্থাপত্য রয়েছে এই সব ভবনে। যেখানে জাপান, চীন, বর্মার মতো দেশের স্থাপত্যের চর্চিত হয়েছে। আবার শান্তিনিকেতনের ইট- কাঠ-পাথরে অথবা গাছের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে রয়েছে কবিগুরুর দর্শন।এগুলিই জানানো হয়েছিল ইউনেস্কোকে।" 

তাই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হয়ে গেল এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। মৌলিক কাঠামোর কোনো রূপভেদ না এনেই এ সবের সংরক্ষণ করতে হবে। কোনও গাছ বদলে দেওয়া যাবে না। এমনকি কোনও অনুষ্ঠানে কেমন ভাবে আলপনা দেওয়া হবে, কেমন করে শঙ্খ বাজানো হবে, তাতেও শান্তিনিকেতনের বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ন থাকবে। এই এলাকায় কোনও নতুন নির্মাণও চলবে না।

roysushmitadiba@gmail.com 

Share this news