Bangla
13 days ago

বিশ্ব অর্থনীতির ওপর যুদ্ধের কালো ছায়া ঘনীভূত

-প্রতীকী ছবি
-প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

ঝাঁকে ঝাঁকে সশস্ত্র ড্রোন ও মিসাইল নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের সাথে ইরান তার সংঘাত বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,, তা দুই দেশের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়তে পারে। আর এটা কোনো গোপন কিছু নয় যে ইসরায়েলের যুদ্ধমুখী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু অনেকদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করে দিতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউও একে সমর্থন করেন। এখন কী তাহলে এসব যুদ্ধবাজদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়নি?

এর আগে অক্টোবর মাসে এক লেখায় আমি যুক্তি দিয়েছিলাম যে ইসরায়েলে হামাসের খুনে হামলার মধ্য দিয়ে এই ধরণের সংঘাত-উত্তেজনা বৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। যদিও গত ৫০ বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে তেলের নিবিড়তা অর্ধেকে নেমে এসেছে, তেল এখনো যাবতীয় জ্বালানি-শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস। এর সরবরাহে বড় বিপরযয় ঘটলে তা বড় ধরণের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে।

তদুপরি, উপসাগরীয় অঞ্চল এখন পরযন্ত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি উৎপাদক। ২০২৩ সালের স্ট্যাটিসটিকাল রিভিউ অব ওয়ার্ল্ড এনার্জি, এ অঞ্চলে বিশ্বের ৪৮ শতাংশ তেলের প্রমাণিত মজুদ আছে আর এখান থেকেই ২০২২ সালে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ তেল উৎপাদিত হয়েছে। আবার ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিস্ট্রিশেনের তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ তেলবাহী জাহাজ যাতায়াত করেছে। আর এটাই খারাপ কথা। [হরমুজ প্রণালী পারস্য উপসাগর থেকে ওমান উপসগার হয়ে ভারত সাগরে আসার একমাত্র জলপথ]। এই প্রণালী হলো বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের  সংকীর্ণ অথচ কৌশলগত পথ । আর তাই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে, এবং যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হলে, তা হবে এক মহা বিপরযয়।

গত সপ্তাহে (১৫-২০ এপ্রিল, ২০২৪) ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আেএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে সমবেত হওয়া বিশ্ব অর্থনীতির নীতি-নির্ধারণের জন্য দায়িত্বশীলরা অবশ্য দর্শকমাত্র। তাঁরা কেবল এটাই আশা করতে পারেন যে মধ্যপ্রাচ্যে বিচক্ষণ পরামর্শগুলো কাজ করবে। তো, বিপরয় এড়ানো গেলে বিশ্ব অর্থনীতির চেহারাটা কেমন হতো বা হবে?

আইএমএফের হালনাগাদকৃত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক থেকে এ বিষয়ে কিছু পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। এমন নয় যে আইএমএফের পূর্বাভাস সবসময় সঠিক হয়। তবে এখানে পদ্ধতিগতভাবে দুনিয়ার অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে তার একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়।

আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবদ পিয়েরে অলিভার গোরিঞ্চাস এ প্রতিবেদনের ভূমিকায় ব্যাখ্যা করেছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে যতোটা আশংকা করা হয়েছিল, তার চেয়ে ভাল করেছে। আর তা হয়েছে মহামারী, ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ, বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং মুদ্রানীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করার পরিণতি হিসেব উৎপাদন ও মূল্যস্ফীতিজনিত অভিঘাতের পরও। তিনি লিখেছেন, “ অনেক হতাশাজনক পূর্বাভাস সত্ত্বেও দুনিয়া একটি মন্দা এড়াতে পেরেছে, ব্যাংকিং খাত সামগ্রিকভাবে সহনক্ষম প্রমাণিত হয়েছে, এবং প্রধান উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো হঠাৎ অর্থায়নের ঘাটতিজনিত সংকটে পড়েনি।” উল্লেখযোগ্য হলো, মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলেও তা নিয়ন্ত্রণহীন মজুরি-মূল্যের চক্র তৈরি করেনি। সার্বিকভাবে, বিশ্ব অর্থনীতি অধিকতর সহনীয় প্রমাণিত হয়েছে, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশায়ও ভালভাবে লাগাম টানা গেছে। এসবই ভাল খবর।

এটাও উল্লেখ্য যে সামষ্টিক উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০২২ ও ২০২৩ সালে আইএমএফের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রক্ষেপণের চেয়ে বেশি হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল নিম্নআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো। একইকথা সত্যি কর্মসংস্থানে বিষয়েও। এখানেও বাদ দিতে হয় শুধু নিম্নআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর দলকে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বেশ তেজীভাব দেখা গেছে যা আবার ইউরোঅঞ্চলে দৃশ্যমান হয়নি।

একটা মজার প্রশ্ন এসেছে যে কেন নিয়ন্ত্রিত মুদ্রানীতি উৎপাদনের ওপর এতো সীমিত প্রভাব ফেলেছে। এর একটা ব্যাখ্যা হলো, রাজস্বনীতি ছিল যথেষ্ট সমর্থনমূলক বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে। আরেকটা ব্যাখ্যা এরকম যে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত ‍সুদের হার বাড়ার বদলে কমে গিয়েছিল। এখন এতে পরিবর্তন আসছে। তৃতীয় ব্যাখ্যাটি হলো নির্ধারিত হারে অনেক বেশি পরিমাণে বন্ধক বিশেষত যুক্তরাজ্যে যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি, মহামারীর সময়ে করা সঞ্চয় ব্যয় মেটাতে সহায়তা করেছে। এটাও এখন শেষ হচেছ। তাই নিয়ন্ত্রিণ মুদ্রানীতির প্রলম্বিত প্রভাব হয়তো এখনো চলছে বলা যায়।

স্বল্পমেয়াদে বিশ্ব অর্থনীতি কৃতি বা কর্মকাণ্ড বিস্ময়ভাবে ভাল হলেও দীর্ঘমেয়াদে চিত্রটা বিপরীত। এই শতকের গোড়া থেকে নিয়ে হিসেব করলে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপির প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। টোটাল ফ্যাক্টর প্রোডাক্টিভিটি (টিএফপি) বা মোট উপকরণের উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধিতে ধ্বস নেমেছে। টিএফপি হলো উদ্ভাবন কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে ভাল পরিমাপ। নিম্নআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় টিএফপির প্রবৃদ্ধিতো ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নেতিবাচক হয়ে গেছে।

আর টিএফপির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়া সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্ধেকের বেশিতে ভূমিকা রেখেছে। আইএমএফের হিসেবানুসারে, বিভিন্নখাতের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পুঁজি ও শ্রমের বেঠিক বরাদ্দ বেড়ে চলা দিয়ে এই শ্লথগতি ব্যাখ্যা করা যায়।  এটায় পরিবর্তন আনা সম্ভব তবে তা খুব সহজসাধ্য নয়। আর এই শ্লথগতির একটা কারণ হলো বিশ্ব বাণিজ্যের গতিময়তা হ্রাস পাওয়া যা আবার সবসময়ই প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

আইএমএফের এই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের মূল বার্তাগুলো হলো: বিশ্বজুড়ে উৎপাদনশীলতা শ্লথ হয়ে পড়ায় সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্ময়করভাবে তেজী হওয়ার পরও (ব্যতিক্রম স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো) দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলাই বাহুল্য যে বড় ধরণের কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

আশার দিক হলো, সামনে আমরা হয়তো নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজস্বনীতি শিথিলতার স্বল্পমেয়াদী উত্থান দেখতে পাবো। শ্রমের সরবরাহ আরো বেড়ে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো উৎপাদনশীলতার দুর্বল প্রবৃদ্ধিকে চাঙ্গা করতে পারে একটি ইতিবাচক বিস্ময়কর অভিঘাত হিসেবে। সফল সংস্কার হয়তো সম্ভাব্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। হতাশার দিক হলো, চীনের প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে। এছাড়া বৈশ্বিক আর্থিক, রাজস্ব, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীতা ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে আরো উত্তপ্ত করে তুলতে পারে যার মারাত্মক অভিঘাত পড়বে জ্বালানি ও পণ্যের মূল্যে। গরিবরা যথারীতি এরকম গণ্ডগোলের সবচেয়ে বড় শিকার হবে।

আমরা হয়তো এখন পরযন্ত বিভিন্ন অভিঘাত প্রত্যাশার তুলনায় ভালভাবে সামাল দিতে পেরেছি। কিন্তু আমরা এখন ঠুনকো ডিমের খোসার ওপর দিয়ে হাঁটছি আর তাই আমাদের অবশ্যই সাবধানে পা ফেলতে হবে।

মার্টিন উলফ ফাইনান্সিয়াল টাইমসের অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া

Share this news