Bangla
a year ago

বিশ্বের শীতলতম শহর ইয়াকুটস্ক: -৫০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মানুষ যেখানে টিকে থাকে

Published :

Updated :

যদি শীতলতম দেশ বা জায়গার কথা মনে করা হয় তাহলে চট করেই এ্যান্টার্কটিকার কথা মাথায় আসবে। কিন্তু সেখানে মানুষের বসবাস সচরাচর দেখা যায় না। কারণ ০° সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নেমে গেলে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে তো তাপমাত্রা ২০° সেলসিয়াসের নিচে নামলেই হাড় কাঁপানো শীতের অনুভূতি হয়।

তবে পৃথিবীতে এমন এক শহর আছে যেখানে শীতকালে গড় তাপমাত্রা থাকে -৩০° সেলসিয়াসের নিচে। জানুয়ারি মাসে সেই তাপমাত্রা কমে মাঝে মাঝে -৫০° সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। তবুও মানুষ সেখানে বসতি গড়েছে, প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে জীবনযাপন করছে। বলছি পৃথিবীর শীতলতম শহর ইয়াকুটস্কের কথা।

রাশিয়ার ইয়াকুটিয়া বা সাখা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী হলো ইয়াকুটস্ক। যা উত্তর মেরু থেকে ২৮০ মাইল দূরে অবস্থিত। রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে এই শহর অবস্থিত হওয়ার কারণে বিশ্বের বাকী অংশের থেকে এই অঞ্চল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন বলা যায়।

সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে এই শীতলতম শহরে। পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের শাসনামলে তার মতবাদের বিরোধীতা পোষণকারীদের নির্বাসিত করা হয়েছিল। সাইবেরিয়া ও সাখা প্রজাতন্ত্রে নির্বাসিতদেরকে গুলাগ ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। ফলে ইয়াকুটস্ককে নির্বাসিতদের শহরও বলা হয়ে থাকে।

ইয়াকুটস্ককে বলা হয় বরফের নরক। এখানকার পানির পাইপগুলো মাটির উপরে স্থাপন করা হয়। কারণ এই শহরের মাটির নিচে ১০০ ফুট পর্যন্ত পুরোটাই বরফে ঘেরা। এমনকি শহরের নদীগুলোও জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। শহরের বাড়ি ও অন্যান্য ভবনের আকৃতি অন্যান্য স্থানের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। মাটির নিচেও বরফ থাকার কারণে বাড়িগুলো বরফের উপরেই নির্মাণ করা হয়। ফলে ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি পুরনো বাড়িগুলো বরফের তারতম্যের কারণে এক দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এখানকার আবহাওয়া অনেক ঠাণ্ডা ও শুষ্ক। বাইরে উন্মুক্ত অবস্থায় কোনো কিছু রাখলেই তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই জমে যায়। যেমন, কলা বাইরে রাখলে তা কয়েক মিনিটের মধ্যে হাতুড়ির মতো ভারি ও শক্ত হয়ে যায়। বাইরে কিছু খেতে বসলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই খাবার পাথরের মতো কঠিন হয়ে পড়ে।  আবার ১০০° সেলসিয়াসের ফুটন্ত গরম পানি বাইরে ছুড়ে মারলে তা মুহূর্তের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফকণাতে পরিণত হয়। কাপড় বা তোয়ালে বাইরে নেড়ে রাখলে তা কাঠের মতো শক্ত হয়ে যায়। এই অঞ্চলের মানুষ মেটাল ফ্রেমের চশমা পড়ে না। কারণ এতে চশমা ত্বকের সাথে আটকে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

যারা এই শহরে গাড়ি ব্যবহার করে তাদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। গাড়ি সচল রাখতে হলে গাড়ির ইঞ্জিন সারাক্ষণ চালিয়ে রাখতে হয়। নাহলে বন্ধ করে রাখলে অল্প সময়ের মধ্যে এর ইঞ্জিনের তেল জমে বরফ হয়ে যায় ও গাড়ির ওপরেও বরফের স্তর জমতে শুরু করে। বিত্তবানেরা অনেকেই হিটার গ্যারেজ ব্যবহার করেন গাড়ি সচল রাখার জন্য। তবে তা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে বেশিরভাগ মানুষই সারাক্ষণ ইঞ্জিন চালু করে রাখে। এতে অনেক জ্বালানির অপচয় হয়। যার ফলে এ শহর যানবাহনের ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়।

প্রতিটি গাড়িতে দুই স্তরে কাঁচ লাগানো হয়। প্রথম কাঁচ গাড়ির ভেতর ঠাণ্ডা বাতাস যেন না ঢুকতে পারে আর দ্বিতীয় কাঁচ ব্যবহার করা হয় গাড়ির ভেতর গরম রাখার জন্যে। রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় গাড়ির কোনো সমস্যা হলে ২০ মিনিটের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বেঁচে থাকারই আশা ছেড়ে দিতে হয়। আবার মোবাইল ফোনও এত কম তাপমাত্রার মধ্যে ঠিকমতো কাজ করে না। তখন এই শীতের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকায় শরীরে ফ্রস্টবাইট ও হাইপোথার্মিয়া শুরু হয়। যার পরিণাম হয় মৃত্যু।

মারাত্মক ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে সেখানকার মানুষেরা পশমের তৈরি কয়েক স্তরের গরম কাপড় পরে থাকে। কিন্তু তাও যেন যথেষ্ট মনে হয় না। এমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় দীর্ঘক্ষণ হাঁটা প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘ সময় বাইরে থাকলে শরীর ঠাণ্ডায় জমে অবশ হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়। তাই সবসময় হাতে একাধিক গ্লাভস পরে থাকতে হয়। একটা পরে থাকলে হাতের আঙ্গুলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। আর বাইরে থাকাবস্থায় গ্লাভস খুললে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রস্টবাইট হয়ে যায়। প্রতি বছর ইয়াকুটস্কে শীতকালে ফ্রস্টবাইটের কারণে অনেক মানুষের অঙ্গহানি ঘটে।

তাই ফ্রস্টবাইট থেকে বাঁচতে স্থানীয়রা কিছুক্ষণ হাঁটার পর কোনো দোকান বা ব্যাংকে ঢুকে বিশ্রাম নেয়। এরপর শরীর খানিকটা গরম হলে পুনরায় হাঁটা শুরু করে। 

এ শহরের দোকান, অফিসসহ সবখানেই তিনটি আলাদা প্রবেশদ্বার থাকে যেন ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস না আসে। বরফ জমে থাকে বিধায় সিঁড়ি অনেক পিচ্ছল থাকে। যার জন্যে সবখানের সিঁড়িতে কার্পেট ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে ফুটপাতে প্রতি ঘণ্টায় বরফের স্তর পরিস্কার করতে হয়।

সাধারণত রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা ২° থেকে ৪° সেলসিয়াস থাকে। অন্যদিকে ফ্রিজারের তাপমাত্রা থাকে -১৮° থেকে -২০° সেলসিয়াস। কিন্তু ইয়াকুটস্ক শহরের তাপমাত্রা এই রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারের থেকেও কম হওয়ায় অনেকেই ঘরের জানালার বাইরে কিংবা বারান্দায় মাছ-মাংস বা অন্যান্য খাবার রাখে। এমনকি বাজারে গেলেও দেখা যাবে বিশাল মাছ ও বিভিন্ন পশুর মাংস উন্মুক্ত অবস্থায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ এত কম তাপমাত্রার কারণে দিনের পর দিন কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই মাছ-মাংস দিব্যি সতেজ থাকে ও পচে যাওয়ার চিন্তা থাকে না।

জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস ইয়াকুটস্কে গ্রীষ্মকাল থাকে। তখন তাপমাত্রা - ১০° থেকে - ২৫° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। যেখানে সূর্য বছরের বাকী আট-নয় মাস বড়জোর টেনেটুনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মতো থাকে, সেখানে এই তিন মাসে ২০ ঘণ্টায়ও সূর্য অস্ত যায় না। কিন্তু তখনও মাটির নিচের বরফ পুরোপুরি গলে না।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে এই শহরের মানুষ কবর দেয় কীভাবে। দুই-তিন দিন ধরে কয়লা দিয়ে কবরের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটি পোড়ানো হয়। এতে সেখানকার বরফ গলে যায়। বরফ সরানোর পর ছয়-সাত ফুট খননের পর মৃতকে কবর দেওয়া হয়। বরফে আচ্ছাদিত থাকার কারণে শত শত বছর আগের মৃতদেহ অক্ষত অবস্থায় এখনও পাওয়া যাবে।

প্রতি বছর এই শহরে প্রায় দুই হাজারের মতো পর্যটক আসে। যদিও বেশিরভাগই ব্যবসায়িক কাজের জন্যে আসে। হীরা, খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতার কারণে এখানে বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ সক্রিয়।

ইয়াকুটস্কে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে -৬৪.৪° সেলসিয়াস। এই অত্যন্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও স্থানীয়রা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চিন্তার বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ গলছে। এই বরফ গলার সাথে সাথে এতদিনের সুপ্ত ভাইরাস জেগে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। মাটির নিচের বরফ বা পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে পৃথিবীর।

m.maliha906@gmail.com

Share this news