Published :
Updated :
চিত্রশিল্পের রেনেসাঁর যুগ বললে চোখে ভেসে ওঠে রাফায়েল, সান্দ্রো বত্তিচেলি, দানতো ব্রামান্তে, টিনটোরেটো, ফ্রা এঞ্জেলিকোর আঁকা পাশ্চাত্যের পৌরাণিক ছবিগুলো, যা বহুবছর ধরে ইউরোপীয় দেয়ালের শোভা বর্ধন করে আসছে। কিন্তু যদি এই উপমহাদেশে চিত্রকলার রেনেসাঁর কথা বলা হয়, তবে রাজা রবি বর্মাকে স্মরণ না করে আর কোথাও যাওয়া যায় না।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নবজাগরণকালে তার চিত্রকর্মগুলোই স্বদেশী মানুষকে শুদ্ধাত্মার দর্শন দিয়েছে, খুঁজে দিয়েছে আপন সংস্কৃতির পরিচয়। তার তুলিতে ভর করে স্বর্গের দেবকুল আপন প্রকাশে নব বল সঞ্চার করেছে একটি জাতিকে। তাই রাজা রবি বর্মা সদা প্রনম্য হয়ে থাকবেন।
ত্রাবাঙ্কোরের প্রাসাদে রবি বর্মার প্রতিকৃতি
কেরলের তৃবন্দ্রামের খুব কাছেই ত্রাবাঙ্কোর রাজ্য। তারমাঝে সবুজের কোলঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম কিলিমানুর (অধুনা শহর)। সেখানেই প্রকৃতি দেবীর অপার সৌন্দর্যকে চোখ ভরে দেখে বেড়ে ওঠা শিশু রবির।
শুধু দেখে ক্ষান্ত নয় সে, হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই দিয়েই ও গাছের পাখিদের, ও বনের ফুলে প্রজাপতির খেলাকে, নদীতে হাতিদের স্নানদৃশ্যকে অবিকল ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় নিজেকে সঁপে দিচ্ছে।
একদিন এক নেমন্তন্নে ত্রাবাঙ্কোর রাজা এলেন রবিদের বাড়ি। দেয়ালে শিশু প্রতিভার খেলা রাজাকে মুগ্ধ করেছিল। রাজা তাকে শিল্পী রমাস্বামীর কাছে জলরং-এ প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে আঁকা শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। হয়ে গেল আঁকার জগতে হাতেখড়ি।
পরবর্তীতে রবি বর্মা রাজার দরবারে কাজ করা ওলন্দাজ থিওডোর জেনসনের কাছ থেকে ইউরোপীয় রীতিতে তৈলচিত্রবিদ্যায় শিক্ষা পান।
যুবক রবি বর্মার বিবাহ হয় এক রাজকন্যার সাথে। তাদের সামাজিক প্রথানুযায়ী বিবাহের পরে বরকে বধূর গৃহে থাকতে হতো। রবি তার আঁকার জগতে দিন কাটাতে ভালোবাসতেন, কিন্তু সে রাজপরিবারে চিত্রকের কাজ জামাতাকে শোভা পায় না, তাই বাঁধ সাধলেন স্ত্রী। কিন্তু রবি বর্মা তার ভালোবাসা ছাড়তে পারেননি। বেরিয়ে পড়েন বাড়ি ছেড়ে, স্বপ্নকে আরও বড় করে পেতে নতুন খুঁটি গাড়েন মুম্বাইতে।
চিত্রশিল্পী হিসেবে রবি বর্মার যাত্রা শুরু হয় বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির প্রতিকৃতি এঁকে। তিনি নানা রাজ্যের রাজাদের ও রাজপরিবারের সদস্যদের ছবি এঁকে দিতেন।
রবির আঁকা দক্ষিণের রাজাদের প্রতিকৃতি
রবির চোখে যা সুন্দর হয়ে ধরা দিতো, সে সেটি সঙ্গে সঙ্গে এঁকে নিজের করে নিতো। সৌন্দর্যের পূজারীর চোখে সুন্দরতা খুব সহজেই ধরা দেয়, তবে রবি বর্মা বিশ্বাস করতেন, সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয়, এ শুধু একটি মুহুর্ত। তাই তিনি চাইতেন প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধকে তার ক্যানভাসে আটকে দীর্ঘজীবন দিতে।
তার ছবির রঙগুলো তৈরি হতো প্রকৃতির কোল থেকে আহরিত উপাদানে। যেমন - হলুদ বেটে হতো হলুদ রঙ, লাক্ষা থেকে লাল, নীল শস্য থেকে নীল। তার বিশ্বাস ছিল লোকে বহুকাল তার চিত্রকলাকে মনে রাখবে। এভাবে যাদের ভালো লাগতো তাদের মডেল করে ছবি আঁকাটা ঝালিয়ে নিতেন।
রবির ছবির নায়িকা ; অপেক্ষারত নারী, অহল্যা, বিখ্যাত চিত্র প্রদীপহাতে নারী
রাজা রবি বর্মা চাইতেন সারা ভারতের প্রাচীন গল্পের ঝুলি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হোক। পাশ্চাত্যের লোকে জানুক ভারতবাসীর আছে নিজেদের গল্প, নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের অপার ঐশ্বর্য। উত্তর থেকে দক্ষিণ -- সারা ভারত ঘুরে বিভিন্ন মন্দির, প্রাচীন স্থাপনা, শাস্ত্রীয় নৃত্য-গীত-নাট্য থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি হতে অঞ্জলীভরে তিনি সংগ্রহ করেছেন তার চিত্রের রসদ।
তার ধ্যানে ভেসে উঠতো রামায়ণ আর মহাভারতের চরিত্রেরা। সেই ভঙ্গিতে দাঁড়াত তার মডেলরা। ক্যানভাসে ধরা দিলো হংসের সাথে আলাপরতা দময়ন্তী, মোহিনী, অহল্যা, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণ, রামের সমুদ্র শাসন, জটায়ু বধ, বিশ্বামিত্রের তপভঙ্গ, সুভদ্রাকে অর্জুনের প্রেম নিবেদন, রাধা-কৃষ্ণ, রাম দরবার, উর্বশী আর পুরুরবা।
সে সময়ের ভারতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিতত্ত্বের কারণে কিছু মানুষকে মন্দির গমন ও শাস্ত্রপাঠ হতে বহু দূরে রাখা হতো, রবি বর্মার ছবিতে তারা নিজেদের ঈশ্বরকে সাকার হতে দেখেছিল। রবির ছবিগুলোয় ঝরে পড়ে শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত -এই নব রসের আস্বাদ। চারিদিকে রবি বর্মার নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল। রবির সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
এইটুকুতেই এই আন্দাজ তো হয় যে রবি নিঃসন্দেহে চিত্রকলার জগতের একচ্ছত্র সম্রাট, এমনিতেও তিনি রাজ পরিবারের সদস্য। তবুও তার রাজা উপাধির পেছনে আছে এক গল্প। কেন তিনি রাজা আর কোথায় তার রাজ্য?
রবি বর্মার এই জয়জয়কার একদল হিংসুটে লোকের মোটেই পছন্দ হয়নি। এরা হলেন সেই দলের লোক যাদের যুগ যুগ ধরে নিজের সময়ের প্রথাগত পরিবর্তন পছন্দ হয়নি। শাস্ত্রীয় অবমাননা ও প্রথাভঙ্গের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, পেশ করা হয় আদালতে। আর উকিল করে বসেন সেই প্রশ্ন।
উত্তরে আসে আইলিয়াম তিরুনালের কথা, ত্রাবাঙ্কোরের মহারাজ। যিনি রবির আঁকা কেশবিন্যাসে ব্যস্ত নায়ার কন্যার ভূয়সী প্রশংসা করে দিয়েছিলেন রাজার খেতাব। তারপর থেকে রবি তার নামের আগে রাজার ব্যবহার করতেন।
রাজা রবি বর্মা এইবারে একটি প্রেস খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন, যাতে লোকে তার ছবির প্রিন্ট সংগ্রহে রাখতে পারে। এইকাজে তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন জার্মান প্রযুক্তিবিদ ফ্রিটজ শ্লেইজার। লাইমস্টোনের ব্লকে লিথোগ্রাফ প্লেটগুলির ছাপ উঠতে থাকলো, এভাবেই বেরিয়ে আসতে শুরু করলো আসল ছবির শত শত প্রিন্ট। পণ্যে বিজ্ঞাপনে পৌঁছে গেলো রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবি। রবি বর্মার নায়িকাদের পরিহিত শাড়িগুলির বিক্রি বাট্টা বেড়ে গেলো।
রবি বর্মার এই প্রেসটিই ছিল সমগ্র ভারতের প্রথম লিথোগ্রাফিক প্রেস, যার শুরুটা হয়েছিল ১৮৯৪ সালে মুম্বাইয়ের ঘাটকোপারে দেওয়ান টি. মাধব রাওয়ের পরামর্শে। প্রেসটির পরিচালনায় ছিল রবির ভাই রাজা বর্মা। এটি পরে ১৮৯৯ সালে মহারাষ্ট্রের মালাভালাতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। পৌরাণিক তৈলচিত্রগুলি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ১৯০৬ সালে তার মৃত্যুর পরেও হাজারে হাজারে মুদ্রিত হতে থাকে।
কিন্তু প্রারম্ভের কিছু বাদেই প্রেসটি বাণিজ্যিক ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে শুরু করে। ১৮৯৯ এর মধ্যে প্রেসটি গভীরভাবে দেনায় ডুবে যায় এবং ১৯০১ সালে সহকারী ফ্রিটজ শ্লেইজারের কাছেই বিক্রি করে দেয়া হয়। শ্লেইজার রবি বর্মার প্রিন্টগুলোর মুদ্রণ ধরে রেখেছিল। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭২ সালে একটি ধ্বংসাত্মক অগ্নিকান্ডে পুরো কারখানাটি লোপ পায়। রবি বর্মার অনেকগুলো মূল লিথোগ্রাফিক প্লেটও আগুনে চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়।
রবি বর্মার চিত্র আলো-আঁধারীর খেলা জানে। মাইসর প্রাসাদে তার ‘প্রদীপ হাতে নারী’ ছবিটির ওপরে একটি সুইচ ওয়ালা বাল্ব রাখা আছে। দর্শনার্থীরা ওটা জ্বালিয়ে নিভিয়ে দেখে, কিন্তু তাতে ছবির আবহে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসে না, এমনি জাদুকরী তার চিত্ররেখার টান।
রাজা রবি বর্মা তার জীবনকালে দুহাজারের বেশি তৈলচিত্র এঁকেছেন। বর্তমানে ত্রাবাঙ্কোরে তার জন্মস্থানে তার প্রায়শই সংরক্ষণের ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রবি বর্মা তার সদা স্মরণীয় চিত্রগুলির জন্যে ১৯০৪ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের কাছে কাইজার-ই-হিন্দ স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৮৭৩-১৮৮০ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। মাদ্রাজ ফাইন আর্টস সোসাইটিতে তিনি পান গর্ভনরের সোনার মেডেল । ত্রাবাঙ্কোর রাজ ও গাইকোয়াডের মহারাজার কাছেও রবিবর্মা পূর্বেই স্বর্ণপদক লাভ করেন।
এ সময়েই তার মুকুটে নতুন পালক হয়ে আসে বিশ্ব স্বীকৃতি। শিকাগো আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে তার পাঠানো আঠারোটি চিত্র ভারতীয় জীবনের খন্ডাংশ তুলে ধরে গুণীজনের প্রশংসা লাভ করে, বিশেষত তার শাড়ি পরিহিতা নারীর চিত্রগুলো বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
২০১৩ সালে রাজা রবি বর্মার সম্মানে বুধের আবিষ্কৃত একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় ক্রেটার ভার্মা।
২০০৮ সালে বলিউডে চিত্রশিল্পী রাজা রবি বর্মার জীবনী নির্ভর চলচ্চিত্র ‘রঙরসিয়া’ নির্মিত হয়েছিল, যাতে মুখ্য চরিত্রে দেখা গিয়েছিল রণদীপ হুদাকে।