Published :
Updated :
ডেকা অর্থ দশ। দশটি রাতের দশটি করে মোট একশটি গল্প। এই গল্পগুলো নিয়েই ক্লাসিক গ্রন্থ 'ডেকামেরন।' লেখক প্রখ্যাত ইতালীয় সাহিত্যিক গিওভানি বোকাচিও (১৩১৩-১৩৭৫)।
তিনি এই গল্পগুলো লিখেছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীতে, কিন্তু আজও গ্রন্থটি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
গ্রন্থটির শুরুতে আমরা দেখতে পাই প্লেগ আক্রান্ত ফ্লোরেন্স থেকে চলে এসে দশজন ব্যক্তি (সাতজন নারী ও তিনজন পুরুষ) নিজেদের একটা ছোট রাজ্য তৈরি করে। সেখানে তারা শুক্র ও শনিবার বাদে সমবেত হয়। তারা পালাক্রমে একেকদিন একেকজন রাজা/ রানী নির্বাচিত করেন। তারপর তারা সবাই গল্পে মেতে ওঠেন।
গল্পগুলোয় বোকাচিও সে সময়ের ইতালির প্রেক্ষাপটে প্লট সাজিয়েছেন। গল্পগুলো মধ্যযুগের হলেও তা অনেকক্ষেত্রেই আধুনিকতার সাক্ষর বহন করে। বহন করে রেঁনেসা-র চিহ্নও।
মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে হওয়ায় বহু গল্পেই এসেছে চার্চের প্রসঙ্গ এবং ধর্মযাজকদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেয়া হয়েছে বহু গল্পে। এ কারণে বইটি পরবর্তীতে অনেক জায়গাতেই নিষিদ্ধ হয়। পুরোহিততন্ত্র বইটিকে নিষিদ্ধ করে। ১৪৯৭ সালে ডেকামেরন পোড়ানোও হয়েছিল।
তবে শুধু ধর্মীয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার জন্যই নয়, তাদের ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসার চিত্র নিপুণভাবে এঁকেছেন বোকাচিও। তাই মধ্যযুগের চার্চতন্ত্র বইটিকে নিরাপদ মনে করেনি।
তবে এর চমৎকারিত্ব অন্য জায়গায়। বইটি একটি ক্ষেত্রে খুবই আধুনিক, সেটি হলো যৌনতাকে কাহিনীতে স্থান দেয়া।
ডি এইচ লরেন্স, ভ্লাদিমির নবোকভ বা আলবার্তো মোরাভিয়াদের বহু আগেই মানুষের যাপিত জীবন আর তাদের দৈহিক আকাঙ্খাকে সাহিত্যে স্থান দেন বোকাচিও। এই কারণে ১৯২০/১৯৩০ এর দশক পর্যন্তও অনেক দেশেই নিষিদ্ধ ছিলো ডেকামেরন।
নারী-পুরুষের ভালোবাসার নিটোল, অকপট প্রকাশ ডেকামেরনের গল্পগুলোকে মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে অতিক্রম করিয়ে আধুনিক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি আধুনিক করে তুলেছে।
অর্থের বিনিময়ে যারা কারও সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, তাদের সেই প্রবণতাকে কোনোক্রমেই প্রশ্রয় দেননি বোকাচিও, বরং তাদের শাস্তির প্রত্যাশা করেছেন। এদিক থেকে মধ্যযুগের মূল্যবোধ তার লেখায় আছে।
কিন্তু যে নারীরা স্বামীর সঙ্গ হতে বঞ্চিত কিংবা তাদের দ্বারা অবহেলিত-উপেক্ষিত; কোনোরকম আর্থিক সুবিধাগ্রহণ ছাড়াই নিজেদের জন্য তাদের দৈহিক প্রয়োজন মেটানোকে তিনি সেসময়ে দাঁড়িয়েও অনৈতিক মনে করেননি, যা অতি আধুনিকতার প্রকাশ।
তার গল্পগুলোর নায়িকারা রক্ত-মাংসের মানুষ। তাই তারা নিষ্কাম প্রেম বা প্লেটোনিক লাভ-এ সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা নিজেদের সমর্পণ করেছে ভালোবাসার মানুষের কাছে, দৈহিক মিলনের আকাঙ্খা সরাসরি প্রকাশ করেছে তাদের কাছে।
বোকাচিও প্রেমকেই মনে করেছেন দুর্বার, শাশ্বত। তাই বোকাচিও তার গল্পগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনুকূল স্বপ্নময় পরিবেশে যথেচ্ছভাবে মিলিত হবার সুযোগ দিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে তার কাব্যিকতা লেখাগুলোকে সুখপাঠ্য করেছে৷ পরিমিতিবোধকে তিনি অতিক্রম করে যাননি, আরোপিতভাবে কোনো যৌন সুড়সুড়ি দেননি। এখানেই তার সাহিত্য সৎ, সুন্দর ও স্বতস্ফূর্ত হয়েছে।
ইউরোপীয় সাহিত্যে বোকাচিও-ই প্রথম দেখিয়েছেন কী করে ভালো গল্প বলা যায়, গল্পকে কী করে জীবন্ত করে তোলা যায়। তার লেখা থেকে পরবর্তী সময়ে বহু লেখক অণুপ্রেরণা নিয়েছেন।
তবে উনবিংশ শতাব্দীতেও বহু দেশে নিষিদ্ধ ছিলো ডেকামেরন। এটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন ইতালির লাকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি.এইচ ম্যাক্যুলিয়াম। বাংলায় এই গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। করেন সৌরেন দত্ত, প্রকাশ করে তুলি কলম।
বেশ কয়েকটি গল্পে আছে চমৎকার হাস্যরস, কয়েকটি অ্যাডভেঞ্চার ও কয়েকটি নাট্যধর্মী গল্পও আছে। সবমিলিয়ে, ডেকামেরন মধ্যযুগে থেকেও দুরন্ত প্রেমের অবাধ, অকপট প্রকাশে হয়ে উঠেছে আধুনিক। যা পাঠকদের বেশ ভালোভাবেই তৃপ্ত করতে সক্ষম।
mahmudnewaz939@gmail.com