Published :
Updated :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যাওয়ার পথে মেট্রোরেলের নিচে সড়কদ্বীপে চোখে পড়ে হলদে রঙের জীর্ণ শীর্ণ এক স্তম্ভ। বামে নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পিছনের দিকে এই স্তম্ভের আরেকটি অংশ রয়েছে যার অবস্থা আরো করুণ। প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে গেটের মতো দেখতে এক স্থাপনা। আর ডান পাশে তিন নেতার মাজারের ভেতর পড়েছে এর আরেক অংশ। এটির অবস্থাও ভগ্নপ্রায়।
এই তিনটি অংশ দেশের ইতিহাসের এক অন্যতম আদি নিদর্শন। মুঘল আমলে তৈরি হওয়া এ স্থাপনা ‘ঢাকা গেট’ বা ‘মীর জুমলার গেট’ নামে পরিচিত। স্থাপনাটির বর্তমান ভগ্নদশা দেখে কেউই চিনতে পারবে না এর ঐতিহাসিক মূল্য। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে মোগল আমলের এ বিরল ইতিহাস প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা গেটের স্তম্ভ প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের। এ ধরনের স্তম্ভ খুবই বিরল। যার উপরে রয়েছে কারুকাজ করা চারকোনা বিশিষ্ট একটি শেড। পশ্চিম পাশের বড় স্তম্ভের পাশেই রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি স্তম্ভ। যার মাঝে টানা অবস্থায় রয়েছে একটি দেয়াল। উঁচু থেকে নিচুতে নামা এ দেয়ালটি প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু পূর্ব পাশের বড় স্তম্ভের সঙ্গে দেয়াল বা প্রাচীর থাকলেও নেই ছোট স্তম্ভ। ইন্টারনেটে ঢাকা গেটের ছবি খুঁজলে একটি গেটের সামনে একদল হাতি, পেছনে সবুজ গাছপালা, মন্দিরের একটি চূড়া- ঢাকা গেটের এমন একটি ছবি দেখা যায়। তবে বর্তমানে প্রায় ৪০০ বছরের বাংলার এই ঐতিহ্য প্রায় বিলীনের পথে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ইরানি ব্যবসায়ীর ছেলে মীর জুমলাকে। বাংলার সুবেদার হওয়ার পর মীর জুমলা এ গেট নির্মাণ করেছিলেন ঢাকা নগরীর নিরাপত্তাব্যূহ হিসেবে। কারণ তখন বাংলার রাজধানী প্রায়ই দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হতো। ১৬৬৩ সালে মগ দস্যুদের থেকে রক্ষা করতে এ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল বলে জানা যায় এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা কোষ’ বই থেকে।
মুঘল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে ব্যবহার করা হতো এ গেট। সে সময় এর নাম ছিল 'মীর জুমলার গেট'। পরে কখনও 'ময়মনসিংহ গেট', কখনও 'ঢাকা গেট' এবং অনেক পরে নামকরণ করা হয় 'রমনা গেট'। এ গেট রমনায় প্রবেশ করার জন্য ব্যবহার করা হতো বলে পরে সাধারণ মানুষের কাছে এটি রমনা গেট নামেই পরিচিতি পায়। তবে বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুসারে এ তোরণ এবং আশপাশের জায়গার নাম দেয়া হয়েছে 'মীর জুমলার গেট'।
সে সময় সুবেদার মীর জুমলা গেটসংলগ্ন এলাকায় একটি নয়নাভিরাম বাগান গড়ে তোলেন, যার নাম ছিল বাগ-ই-বাদশাহি বা সম্রাটের বাগান। ব্রিটিশ আমলে এই বাগানটিকে ঘোড়দৌড়ের জন্য ব্যবহার করা হতো, যেখান থেকে এই বাগানের নাম হয় ‘রেসকোর্স ময়দান’। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেই বাগানের নাম আরো এক দফা পরিবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নাম দেয়া হয়, যা বর্তমানে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অন্যতম জনপ্রিয় পার্ক।
ব্রিটিশ আমলে অন্যান্য অনেক মুঘল স্থাপনার মতো ঢাকা গেটও হয়ে ওঠে জৌলুসহীন। সংস্কারের অভাব, অবহেলা, অযত্নে স্থাপনাটি হয়ে পড়ে জীর্ণ। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস স্থাপনাটিকে ব্রিটিশ স্থাপত্যকলা অনুসারে পুনরায় নির্মিত করেন। যার ফলে স্থাপনাটি মুঘল শাসনামলের হলেও এর স্থাপত্যধারা ইউরোপীয় স্থাপত্যধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্থাপনার দেয়ালে কার্নিশ আকৃতির ডিজাইন এবং কেন্দ্রীয় স্তম্ভের গোলাকার আলংকারিক কাঠামো ইউরোপীয় স্থাপত্যধারাকে অনুসরণ করে বানানো। দেশভাগের পরে পাকিস্তান সরকার এই স্থাপনার সংস্কার করে। ১৯৫০ সালে এই স্থাপনাসংলগ্ন এলাকাতে রাস্তাঘাট এবং বসতবাড়ি গড়ে ওঠে। যার ফলে স্থাপনাটি আরেক দফা সংস্কার করা হয়।
তিন নেতার মাজারের অংশ একটু ভালো হলেও বাকি দুই অংশের অবস্থা করুণ, ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা গেট তত্কালীন ঢাকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্ববহ এই স্থাপনার সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এই চমৎকার স্থাপনাটির চুন-সুরকির আস্তরণ ঝরে গিয়ে এর হতশ্রী রূপ বেরিয়ে এসেছে অনেক জায়গায়। তিন নেতার সমাধিতে যে অংশ, তা সংস্কার করা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। আর তিন নেতার মাজারে কোনো অনুষ্ঠান হলেই এই অংশটা রং করা হয়। কিন্তু বাকি অংশগুলো অন্ধকারেই রয়ে যায়। স্থাপনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায়িত্ব নেয়নি। আবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্থাপনাটিকে ‘হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করেছে, কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
পাশের দেশ ভারতে ‘ইন্ডিয়া গেট’ যেমন জনপ্রিয় ও সংরক্ষিত একটি ঐতিহ্য, আমাদের ঢাকা গেট-ও তেমন হতে পারত যদি প্রথম থেকেই এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ঢাকা গেট এর সংস্কারের জন্য ৭৪ লক্ষ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখনো কাজ শুরু হয়নি। এই ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যথায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে মুঘল আমলের এ প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য।
ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।