Published :
Updated :
আজ থেকে বছর দশেক আগেও জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে ধানমণ্ডি লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মানুষের চোখে পড়তো জাহাজ আকৃতির একটি চমৎকার বাড়ি। খয়েরি রঙের সেই বাড়িটি পরিচিত ছিলো জাহাজবাড়ি নামেই। তবে বাড়িটির মূল নাম ছিলো চিশতিয়া প্যালেস।
ব্যবসায়ী এ কে এম আনোয়ারুল হক চৌধুরী বাড়িটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৪ সালে কাজ সম্পন্ন হয়। প্রায় ষোল কাঠা জমির ওপর এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন তিনি৷
১৯৫২ সালে জন্ম নেয়া আনোয়ারুল হক চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন৷ পরবর্তীতে ব্যবসা ও এনজিও কার্যক্রমে যুক্ত হন৷ বাড়িটি শুরুতে জাহাজ আকৃতির ছিলো না। ১৯৯৬ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন লোক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করায় বাড়িটির লেকসংলগ্ন প্রাচীরটি ভেঙে ফেলতে হয়। এরপর আনোয়ারুল সাহেব বাড়ির প্রাচীরটি জাহাজের মতো আকৃতিতে পুনঃনির্মাণ করেন৷
বাড়িটি ছিলো ধানমণ্ডি ৫/এ তে অবস্থিত ৬০ নং বাড়ি। আনোয়ারুল হক চৌধুরী পরিচিত ছিলেন 'শের-এ-খাজা' নামে আর বাড়িটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিলো 'চিশতিয়া প্যালেস।'
শের-এ-খাজা এ কে এম আনোয়ারুল হক চৌধুরী, ছবি: ফ্লিকর
শের-এ-খাজা নিজে চিশতিয়া ঘরানার (খাজা মইনুদিন চিশতি (রহ) এর অনুসারী) লোক ছিলেন। সুফিবাদে বিশ্বাস রাখতেন। ব্যবসা ও এনজিও কার্যক্রম চালাতেন তার বাড়ি থেকেই। বাইরে যেতেন খুবই কম।
বাড়িটির আকৃতির সাথে গির্জার মিল থাকায় স্থানীয় অনেকেই এটিকে গির্জাই মনে করতেন। কেউ কেউ আবার মনে করতেন, এটি রহস্যময় বাড়ি। বাড়িটিতে জ্বিন আছে বলেও জোর গুঞ্জন ছিলো।
চিশতিয়া প্যালেস সত্যিকার অর্থেই ছিলো প্রাসাদতুল্য। বাড়িটি বিস্তৃত ছিলো ১৫.৮১ কাঠা জায়গা জুড়ে। প্যালেসে প্রবেশের জন্য ছিলো দুটো ফটক। প্রথম ফটক দিয়ে প্রবেশের পর দেখা যেত প্রকাণ্ড এক সুইমিংপুলের। সেখান থেকে আরেকটু সামনে এগোলেই দেখা যেতো দ্বিতীয় ফটকটি।
দ্বিতীয় ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা মিলতো একটি বারান্দার, যার পাশ দিয়ে ছিলো প্যালেসে উঠে আসার সিঁড়ি৷ মোট ৩৭ টি গম্বুজ ও মিনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বাড়িটির প্রধান গম্বুজটি ছিলো লম্বায় মূল ভবনের প্রায় পাঁচগুণ।
শের-এ-খাজা জনসমক্ষে আসতেন খুবই কম। তবে তাকে নিয়ে বেশ চর্চা ও আলোচনা হতো ভিন্ন একটি কারণে। তিনি ভালো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদদের সাথে ছিলো তার নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে ছিলো তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক।
তার মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় দেব গৌড়া ছিলেন। ১৯৯৬ দেব গৌড়া ও ১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন তিনি।
এছাড়া সাংবাদিক নঈম নিজামের এক লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতা আসা ও সরকার গঠনে জাতীয় পার্টির সাহায্য নেয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের বেশ যাতায়াত ছিলো তার বাড়িতে।
তার সাথে রাশিয়া, আমেরিকা, পাকিস্তানের বিভিন্ন কূটনীতিক / রাজনীতিকরাও বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎ করেছেন।
জাহাজবাড়ি তথা চিশতিয়া প্যালেস ছিলো মূলত এনজিও কার্যক্রম পরিচালনার জায়গা। ১৯৮১ সালে শের-এ-খাজা 'ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন' নামে একটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। সেটির কার্যক্রম বাড়িটি তৈরির পর এখান থেকেই পরিচালিত হতো।
এছাড়া 'চিশতিয়া গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ' নামে তার প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। তিনি একসময় ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী।
তবে সুফি ঘরানার প্রতি আগ্রহী হলেও ও অনেকে তাকে পীর মনে করলেও তিনি কোনো দরবার প্রতিষ্ঠা বা মুরিদির ব্যবস্থা করেননি। এসব ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন। তবে আলোচিত কোনো কোনো পীরদের যাতায়াত ছিলো এই জাহাজবাড়িতে।
জয়পুরহাটের আলোচিত পীর মজিবর রহমান চিশতি ও ঢাকার সায়দাবাদের সায়দাবাদি হুজুরের যাতায়াত ছিলো তার বাড়িতে। মজিবর রহমান চিশতি বেনজির ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সফল ভবিষ্যদ্বাণী করার পর তার সাথে দেখা করতে বেনজির বাংলাদেশ আসেন৷ আবার, সায়দাবাদি হুজুরের ছিলো নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ঘনিষ্টতা। তার সাথে দেখা করতে শাহবাজ শরিফ ঢাকা এসেছিলেন।
আকৃতিতে সাদৃশ্য থাকায় বাড়িটিকে গির্জা মনে করতেন অনেকে, ছবি: উইলাভ আওয়ার বাংলাদেশ
শের-এ-খাজা তথা আনোয়ারুল সাহেব রাজনীতির সব খোঁজও রাখতেন। এজন্য তাদের সাথেও ছিলো সুসম্পর্ক।
বর্তমানে এখানে দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা এপার্টমেন্ট 'চিশতিজ ইয়ট', ছবি: শান্তা হোল্ডিংস
২০১১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আনোয়ারুল হক চৌধুরীর মৃত্যু হয়। নইম নিজাম তার এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, শের-এ-খাজা তাকে বাড়িতে থাকা জ্বিনদের বিষয়ে জানিয়েছিলেন, নিজ মৃত্যু নিয়েও একটু চিন্তিত ছিলেন!
তার মৃত্যুর পর তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী রেহানা চৌধুরী, পুত্র রুবেল ও কন্যা সাদিয়া এখানেই থাকছিলেন৷ তবে বাড়িটির কিছু স্থানে ফাটল ধরায় তারা এটিকে ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করার দিকে আগান।
গুলশানের 'শান্তা হোল্ডিং' এর সাথে তাদের চুক্তি মোতাবেক ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হয় বাড়ি ভাঙার কাজ।
তবে প্রচণ্ড টেকসই ছিলো বাড়িটির গড়ন। যার কারণে ভাঙার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হতে ২০১৬ সালেরও কয়েক মাস পেরিয়ে গিয়েছিলো। এরপর চুক্তি মোতাবেক তিন তলা সেই জাহাজবাড়ির জায়গায় এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ১৪ তলা ভবন।
'চিশতিজ ইয়ট' নামের এই ভবনটিতে আছে ব্যায়ামাগার, সুইমিংপুলসহ বিভিন্ন সুবিধা। এখানে বর্তমানে ৩০০০ স্কয়ার ফিটের ২০ টি এপার্টমেন্ট রয়েছে। বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী নাহাস আহমেদ খলিল কাজ করেছেন ভবনের নকশাকার হিসেবে।
বর্তমানে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনটিতে নাগরিক সুবিধার কমতি নেই। তবে ইট কাঠের এই নগরিতে ধানমণ্ডি লেকের মতো প্রশান্তিকর জায়গার শোভাবর্ধন করতো ' জাহাজবাড়ি' বলে খ্যাত সেই বাড়িটি। আজও যখন স্নিগ্ধ কিংবা অবসন্ন কোনো বিকেলে একটু বয়স্ক কেউ ধানমণ্ডি লেক ধরে হেঁটে যান তখন 'চিশতিজ ইয়ট' তাদের মনে করায় 'চিশতিজ প্যালেস' এর কথা; লোকে যার দিকে তাকাতো অসীম কৌতূহলে, যে বাড়ি নিয়ে ছিলো নানান প্রচলিত কথা, মানুষ যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলো জাহাজবাড়ি।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
mahmudnewaz939@gmail.com