Bangla
2 days ago

ঈদে গরুর মাংস রান্নার যত বৈচিত্র‍্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

Published :

Updated :

ঈদ হোক কিংবা বিয়েবাড়ি, দাওয়াত হোক বা বাড়ির রোজকার খাওয়াদাওয়া—গরুর মাংস ছাড়া যেন জমেই না! বাঙালির রান্নাঘরে গরুর মাংস মানেই নানা রকম পদ, নানা ঘ্রাণ, নানা স্মৃতি। একই উপকরণ দিয়ে কত রকমের যে স্বাদগত বৈচিত্র‍্য  তৈরি হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! কেউ পছন্দ করেন ঝাল ও ঘন ঝোল, কেউ ভালোবাসেন মোলায়েম ও সুগন্ধি তরকারি। চলুন, এক এক করে চেনা যাক গরুর মাংসের কিছু জনপ্রিয় ও বিশেষ রান্না, যেগুলো আমাদের রান্নাঘরের ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

ভিন্দালু

বিদেশি নামে বিভ্রান্ত হবেন না—ভিন্দালু এখন আমাদের রান্নাঘরের পরিচিত মুখ। মূল নাম 'ভিনে দ্য আলহোস।' পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে আসা এই রান্নায় থাকে ভিনেগারের টক, শুকনো মরিচের ঝাল আর রসুনের তীব্রতা। ভিনেগার, আদা বাটা আর রসুন বাটায় মেরিনেট করে মাংস রান্না করা হয়।  গরুর মাংসের ভিন্দালু রান্না করলে সেটা হয়ে যায় একটু ভিন্ন স্বাদের—ঝাল, টক আর হালকা মিষ্টির এক দুর্দান্ত মিশেল।

লাল ভুনা

যেখানে মাংস আর মসলা একসঙ্গে মিশে গাঢ় লাল রঙে রূপ নেয়, সেটাই লাল ভুনা। দেখতে যেমন লালচে-ঘন, খেতেও তেমন ঝাল আর ঘ্রাণে ভরপুর। অনেকে বলেন, এটা হলো “রান্নাঘরের রাজা।”

ঈদে কিংবা দাওয়াতে, এই পদ না থাকলে যেন খাবারের তালিকাটা পরিপূর্ণতা পায় না। এক্ষেত্রে মাংসটা একটু শক্ত হলেও চলে—কারণ লাল ভুনার আসল রস আসলে তার তেল-ঝরঝরে ঝোলেই। আর ঈদের টাটকা মাংসের লাল ভুনা হলে মাংস হয়ে যায় আরও নরম। 

রেজালা

এই পদটা যেন একটু শান্ত, সৌম্য স্বভাবের। ঝাঁজ নেই, নেই খুব বেশি ঝাল। বরং দুধ, দই, ঘি আর মসলা মিলে তৈরি হয় মোলায়েম এক তরকারি—যার নাম রেজালা।  পোলাওয়ের সঙ্গে খেতে এই পদ যেন একদম নিখুঁত। রাজকীয় খাবারের তালিকায় রেজালার একটা পাকাপাকি জায়গা আছে। তাই কোরবানির ঈদে অতিথি আপ্যায়নে রেজালা হতে পারে খুব ভালো একটি পছন্দ। চাইলে শাহী রেজালা কিংবা ঝাল পছন্দ করলে ঝাল রেজালাও বানিয়ে ফেলতে পারেন। 

কালা ভুনা

চট্টগ্রামের মানুষ যদি শোনেন, গরুর মাংসের কথা হচ্ছে আর ‘কালা ভুনা’র নাম আসেনি—তাহলে রাগ করতেই পারেন! এটা শুধু একটা রান্না না, একটা আবেগও বটে!  ঘন করে ভাজা পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ, কালোজিরা—সব মিলিয়ে মাংসটা হয়ে ওঠে কালচে রঙের, মশলাদার আর ঝাঁঝালো। ঘ্রাণেই বোঝা যায়, এটা বারবার চেখে দেখার মতো মতো একটা পদ। চালের রুটি, পোলাও বা পরোটার সাথে খুব মানানসই। 

মেজবানি মাংস

একটা সময় ছিল, গ্রামে-গঞ্জে খবর ছড়িয়ে যেত—“অমুক বাড়িতে মেজবান”। তার মানে, বড়ো কড়াইতে হাড়সহ মাংস, প্রচুর শুকনা মরিচ, সরিষার তেল আর দীর্ঘ সময়ের রান্না। মেজবানি মাংস শুধু খাওয়ার বিষয় নয়, এটা সামাজিক উৎসবের প্রতীক। ঝালটা একটু বেশিই হয়, কিন্তু সেই ঝালের মাঝেই থাকে এক অদ্ভুত রসায়ন, যার টানে অনেকেই এটি বারবার খেতে চান। মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলেই এই রান্নাটি বেশি প্রচলিত। 

গরুর মাংসের শুটকি

শুটকি বলতে আমরা সাধারণত মাছ বুঝি, কিন্তু পাহাড়ি এলাকাগুলোতে গরুর মাংসের শুটকিও জনপ্রিয়। মাংস শুকিয়ে রেখে পরে তা মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। কড়া ঘ্রাণ, তীব্র স্বাদ আর শক্ত মাংস—এই পদ সহজে সবার পছন্দ না হলেও যাঁরা খান, তাঁরা আবার ভীষণ পছন্দ করেন। গরুর মাংসের এই শুঁটকি ময়মনসিংহ অঞ্চলেও খুব জনপ্রিয়। সেখানে তারে গেঁথে হলুদ-মরিচ মাখানো মাংস রোদে শুকানো হয়। তারপর বয়ামে ভরে সারা বছর সংরক্ষণ করা হয়। 

শিক কাবাব

বিকেলে হঠাৎ অতিথি চলে এলে বা কোরবানির ঈদে পারিবারিক গেট টুগেদারে  ভিন্ন কিছু আনতে চাইলে, শিক কাবাবই সেরা। কিমা করা মাংস মশলা মেখে শিকে গেঁথে কয়লার আগুনে সেঁকে নেওয়া হয়। ঘ্রাণটা নাকে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যেন মুখে জল এসে পড়ে। এর গায়ে লেগে থাকা ধোঁয়ার গন্ধই এর সবচেয়ে বড় পরিচয়।

বটি কাবাব

শিক কাবাবের মতো হলেও এখানে মাংস থাকে বড়ো টুকরো করে। এই 'বটি' উর্দু শব্দ, অর্থ 'চারকোনা।'  মশলা মাখানো সেই টুকরোগুলো কয়লার আগুনে গ্রিল করা হয় ধীরে ধীরে। বাইরে হালকা খাসা, ভিতরে নরম—এই কাবাবের স্বাদ একবার মুখে পড়লে সহজে ভুলা যায় না। সাধারণত রাতের স্পেশাল আয়োজনেই এটি জায়গা করে নেয়।

গরুর মাংসের কোরমা

রান্নাঘরের আরেক রাজকীয় পদ—কোরমা। কাজুবাদাম, ঘি, কেওড়া জল, এলাচ-দারুচিনি—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক ঘন, সুগন্ধি, মোলায়েম তরকারি। ঝাল কম, কিন্তু স্বাদে ভরপুর। মাংসটা হয় নরম, মুখে দিলেই যেন গলে যায়। ঈদ কিংবা বিয়েবাড়ির পোলাওয়ের সঙ্গী হিসেবে কোরমার চেয়ে উপযুক্ত পদ খুব কমই হয়। 

চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংস

খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা অঞ্চলের এই বিখ্যাত মসলা দেখতে একরকম গাছের ডাঁটার মতো, আর খেতে খুবই খাসা।গরুর মাংসের সঙ্গে এই চুইঝাল মিশলে সেই স্বাদ হয়ে ওঠে মোহনীয়। মাংসটা হয়ে যায় নরম, ঘ্রাণটা হয় অন্যরকম, আর খাওয়ার পর জিভে থেকে যায় দীর্ঘস্থায়ী একটা ঝাঁজমাখা স্মৃতি। যাদের ঝালপ্রেম একটু পরিণত ধরনের, তাদের এটা বেশি পছন্দ হয়। 

সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস

সিলেট অঞ্চলের গর্ব—সাতকড়া! দেখতে বড়ো লেবুর মতো হলেও, স্বাদে আছে এক গভীর টক-মিষ্টি টুইস্ট।  গরুর মাংসের সঙ্গে সাতকড়া মানেই এমন একটা স্বাদ, যেখানে ঝাল, টক আর কষানো গ্রেভি একসঙ্গে খেলতে থাকে জিভে। অনেকে সিলেটি খাবার বলতেই এই পদটার খোঁজ করেন। অনেকে তো সাতকড়া ফ্রিজে রেখে বছর জুড়েই এই রান্নার স্বাদ নিতে চান!

কাটা মসলায় গরুর মাংস 

সব মসলা—আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ—সবই কাটা হাতে, একদম ঘরোয়া ভাবে। মাংসটা ধীরে ধীরে কষানো হয়, তেল-মসলা আলাদা হয়ে আসা পর্যন্ত। এখানে হলুদ গুঁড়া বা মরিচ গুঁড়া ব্যবহার হয়না৷ দেয়া হয়না কোনো বাটা মসলাও। স্বাদটা হয় খাঁটি, ঝাঁঝালো। চালের রুটি বা পোলাওয়ের সঙ্গে এই মাংস খেলে মনে হয়, বাড়ির রান্নার চেয়ে আপন কিছু নেই। 

গরুর মাংসের এই বিচিত্র সব রূপ দেখলেই বোঝা যায়—একই উপকরণ কী অসাধারণ রূপে রূপান্তরিত হতে পারে রান্নার গুণে! আমাদের প্রতিদিনের খাবার থেকে শুরু করে উৎসব-অনুষ্ঠান—সবখানেই গরুর মাংসের কোনো না কোনো রূপ থাকে, কখনো লালচে ঝাল, কখনো মোলায়েম সুগন্ধি, কখনো কড়া আর মজাদার। এসব রান্না শুধু স্বাদের নয়, ভালোবাসার, ঐতিহ্যের এবং গল্পের অংশ।

Share this news