Bangla
2 days ago

ঘি-তেল-মাখন: স্বাস্থ্যের জন্য কোনটি কেমন?

(উপরে) ঘি, (নিচে)সরিষার তেল ও মাখন
(উপরে) ঘি, (নিচে)সরিষার তেল ও মাখন

Published :

Updated :

ফ্যাট অর্থাৎ স্নেহ বা চর্বিজাতীয় খাবার আমাদের খাদ্যতালিকার এক অপরিহার্য অংশ। এটি শরীরকে শক্তি দেয়, হরমোন তৈরিতে সহায়তা করে এবং ভিটামিন এ, ডি, ই, কে-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন শোষণে সাহায্য করে। তবে সব ধরনের ফ্যাট এক রকম নয়। রান্নাঘরের তিন চেনা সঙ্গী, তেল, ঘি এবং মাখনন প্রতিটির স্বাদ, গুণাগুণ ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব আলাদা।

যেখানে ঐতিহ্যবাহী রান্নায় ঘি ও মাখন ব্যবহার হয় তাদের ঘন সুবাস আর মোলায়েম স্বাদের জন্য, আধুনিক খাদ্যাভ্যাসে ভরসা করা হয় উদ্ভিজ্জ তেলের ওপর, বিশেষ করে এতে থাকা অস্মৃক্ত চর্বির কারণে। তাই কোনটি বেছে নেবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্য লক্ষ্য, রান্নার ধরন এবং সাংস্কৃতিক পছন্দের ওপর। দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকতে চাইলে প্রতিটির গুণ ও সীমাবদ্ধতা জানা জরুরি।

ঘি, মাখন ও তেলের পুষ্টিগুণ তুলনা

ঘি তৈরি হয় মাখন গরম করে, যাতে এর ভেতরের জল ও দুধের অংশ আলাদা হয়ে গিয়ে থাকে কেবল খাঁটি চর্বি থাকে। এতে থাকে সম্পৃক্ত চর্বি, আর থাকে ভিটামিন এ, ডি, ই, কে।

ঘি-তে আছে বুটিরিক অ্যাসিড যা এক ধরনের শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ঘিতে পাওয়া যায় সিএলএ (কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড), যা রোগ প্রতিরোধে এবং বিপাকক্রিয়া ঠিক রাখতে সহায়ক বলে গবেষণা ইঙ্গিত দেয়।

মাখন তৈরি হয় ক্রিম চার্ন বা চরণ করে, যেখানে ফ্যাটের সঙ্গে অল্প পানি ও দুধের কঠিন অংশ থেকে যায়। এটি প্রায় ৮০ শতাংশ চর্বি, যার বেশিরভাগই সম্পৃক্ত। এতে ভিটামিন এ ও ডি থাকে। তবে মাখনে কোলেস্টেরল ও ল্যাকটোজ থাকার কারণে এটি ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু ব্যক্তি বা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য কম উপযোগী।

অলিভ, সূর্যমুখী, সরিষা, সয়াবিন বা নারকেল উদ্ভিজ্জ ও বীজের তেলে ফ্যাটের ধরনভেদে ভিন্নতা থাকে। অলিভ ও সরিষা তেলে থাকে মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা হৃদ্‌স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলে থাকে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা পরিমিত পরিমাণে উপকারী। নারকেল তেল যদিও উদ্ভিজ্জ, তবুও এতে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ অনেক বেশি, ঘি বা মাখনের মতোই। 

রান্নায় ব্যবহার: স্মোক পয়েন্ট ও তাপ-সহনশীলতা

স্মোক পয়েন্ট অর্থাৎ কোন তাপমাত্রায় চর্বি ভেঙে ধোঁয়া ওঠা শুরু করে এই বিষয়টি বলে দেয় কোন চর্বি কোন ধরনের রান্নার জন্য উপযুক্ত।

ঘি ভাজা, সাঁতলানো, ডিপ ফ্রাই এর জন্য৷ মাখন বেকিং, কম তাপে রান্নার ক্ষেত্রে। অলিভ অয়েল (এক্সট্রা ভার্জিন) সালাদ ড্রেসিং, হালকা ভাজার জন্য। সরিষার তেল, রাইস ব্র‍্যান বা রিফাইন্ড ভেজিটেবল অয়েল ডিপ ফ্রাই, রোস্টিং এর জন্য। 

স্বাস্থ্যগত দিক: কোন ফ্যাট শরীরের জন্য বেশি সহায়ক?

হৃদ্‌স্বাস্থ্যর ক্ষেত্রে অলিভ, সরিষা, ক্যানোলা এই তেলগুলোতে থাকা অসম্পৃক্ত চর্বি, খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়ায়। ঘি পরিমিত খেলে এইচডিএল বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, তবে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি থাকলে নিয়ন্ত্রণ জরুরি। মাখনে কোলেস্টেরল ও সম্পৃক্ত চর্বি বেশি, তাই কম খাওয়াই ভালো।

ঘি-র বুটিরিক অ্যাসিড অন্ত্রের আস্তরণ শক্ত রাখতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।মাখনেও অল্প পরিমাণ থাকে। তেলে সাধারণত এই উপাদান থাকে না। 

ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, তিনটিতেই ক্যালোরি প্রায় সমান যা প্রতি গ্রামে প্রায় ৯ ক্যালোরি। ঘি ও মাখন তুলনামূলকভাবে পেট ভারের অনুভূতি দিতে পারে। তেল, বিশেষ করে যেসব তেলে ওমেগা-৬ বেশি, তা অতিরিক্ত খেলে বিপাকক্রিয়ায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।

কোলেস্টেরলের ব্যাপারে, অতিরিক্ত মাখন এলডিএল বাড়াতে ও প্রদাহ বাড়াতে পারে। উদ্ভিজ্জ তেল, বিশেষত অলিভ অয়েল, পলিফেনল ও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ, যা হৃদ্‌রক্ষায় কাজ করে। তবে রিফাইন্ড তেল প্রদাহের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

স্বাদ ও রান্নায় বহুমুখিতা

ঘি-র বাদামি, সুবাসিত স্বাদ বাঙালি রান্না, খিচুড়ি, ভাত বা মিষ্টিতে অন্য মাত্রা যোগ করে।মাখনের ক্রিমি ভাব বেকিং, সস বা কন্টিনেন্টাল খাবারকে সমৃদ্ধ করে।

তেলের স্বাদ বিভিন্ন যেমন, অলিভ অয়েল ভূমধ্যসাগরীয় খাবারে মানানসই, সরিষার তেল উপমহাদেশীয় রান্নায় ঝাঁজ আনে, সূর্যমুখী তেল নিরপেক্ষ স্বাদের জন্য রোজকার রান্নায় ব্যবহৃত হয়।  এক্ষেত্রে রেসিপি অনুযায়ী সঠিক ফ্যাট বেছে নেওয়াই মূল কথা।

সাংস্কৃতিক ও খাদ্যাভ্যাসের দৃষ্টিভঙ্গি

আয়ুর্বেদে ঘি-কে ‘সাত্ত্বিক’ খাবার বলা হয় যা শরীর-মনকে পুষ্ট ও শান্ত করে, হজমশক্তি বাড়ায়। পশ্চিমা রান্নায় মাখন এক অপরিহার্য উপাদান, বিশেষ করে বেকিংয়ে। তেল আধুনিক, স্বাস্থ্য সচেতন খাদ্যাভ্যাসের অংশ; ভেগান বা ল্যাকটোজ-ফ্রি ডায়েটে এটি প্রধান পছন্দ।

তেল, ঘি, নাকি মাখন—কোনটি বেছে নেবেন?

আপনার স্বাস্থ্যগত লক্ষ্য ও রান্নার স্বাদের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে ভিন্নতা আসতে পারে। 

হৃদস্বাস্থ্যের জন্য মাঝেমধ্যে অলিভ, সরিষা বা ক্যানোলা তেল বেছে নিতে পারেন। ঘি-সমৃদ্ধ খাদ্যের তুলনায় অলিভ অয়েল-সমৃদ্ধ খাদ্য হৃদ্‌রোগের ঝুঁকির মানদণ্ডে বেশি ইতিবাচক ফল দেয়। ঐতিহ্যবাহী স্বাদ ও হজমের জন্য অল্প পরিমাণ ঘি আদর্শ। বেকিং বা মাঝে মাঝে বিশেষ রান্নায় মাখনই হতে পারে সেরা পছন্দ। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারসাম্য। একই ধরনের চর্বি প্রতিদিন বেশি না খেয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন চর্বি পালা করে ব্যবহার করলে স্বাদ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সবই ঠিকঠাক বজায় থাকবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই বাধ্যতামূলক।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share this news