Published :
Updated :
মানুষটির বয়স ৬৯ বছর। বাস করেন কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার আলগাপাড়া গ্রামে। বয়সের ভাড়ে অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন তিনি। তবে এখনও আগের মতোই দৃঢ় তার আত্নবিশ্বাস। আর তাই তো এই বয়সে এসেও মানুষের শেষ যাত্রার সঙ্গী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
লিখছি মনু মিয়ার গল্প। গোরখোদক হিসেবে পরিচিত মনু মিয়া গত ৫০ বছরে তিন হাজারের বেশি কবর বিনা পারিশ্রমিকে খুঁড়েছেন। শুধু কিশোরগঞ্জেই নয়, বরং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও তিনি প্রায়ই ছুটে যেতেন মানুষের কবর খোঁড়ার কাজে।
আর এই কাজে মনু মিয়ার সঙ্গী ছিল একটি ঘোড়া। এর নাম ছিল বাহাদুর। আর এই বাহাদুরের পিঠে চড়েই তিনি মানুষের কবর খুঁড়তে যেতেন। জানা যায়, গত ১০ বছর আগে মনু মিয়া তার বাজারের দোকান বিক্রি করে ঘোড়াটি কিনেছিলেন। আর তখন থেকেই এই ঘোড়া তার নিত্য দিনের সঙ্গী।
গত ১৪ই মে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হোন মনু মিয়া। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। আর সেই সময় এলো এক মর্মান্তিক খবর। মনু মিয়ার সেই বাহাদুর নাকি আর নেই।
দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে অবলা এই প্রাণীটিকে। সেখানকার একটি মাদ্রাসার পাশের ডোবা জমিতে লাশ পড়ে আছে বাহাদুরের। আর এমন ঘটনার পর তার এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে।
যেই ঘোড়াটি মনু মিয়া ব্যবহার করতেন মানুষের চির বিদায়ের কাজে, সেই ঘোড়াটির সাথে এমন আচরণে হতবাক পুরো এলাকাবাসী।
মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ থাকতে পারে। কিন্তু একটি নিরীহ প্রাণীর সাথে এমন অমানবিক আচরণ কি কখনোই একটি সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে?
স্থানীয়দের মতে, একজন দক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার বেশ সুনাম রয়েছে। কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই তিনি সেখানে ছুটে যেতেন কবর খোঁড়ার কাজে।
কিশোরগঞ্জের চর অধ্যুষিত অনেক দুর্গম গ্রামেও মনু মিয়া নির্দ্বিধায় ছুটে যেতেন কোনোরকম কালবিলম্ব না করেই।
আর এসব কাজে তিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে নিজের শরীরের দিকেই খেয়াল রাখেননি। আর তাই তো শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তখন তার নিত্যদিনের সঙ্গী বাহাদুরকেই শেষ করে দিল মানুষরূপী কিছু পশু।
ব্যক্তিজীবনে কোনো সন্তান নেই মনু মিয়ার। স্ত্রী রহিমা বেগমের সঙ্গে নিজ গ্রামে বসবাস করেন তিনি। আর সেখান থেকেই মনু মিয়া ছুটে যান মানুষের শেষ ঠিকানা বানানোর কাজে।
প্রিয় ঘোড়া বাহাদুরের মৃত্যুর খবর এখনো জানেন না মনু মিয়া। কারণ এই ভাঙ্গা শরীরে এত বড় আঘাত হয়ত সইতে পারবেন না তিনি।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সাধাসিধে মনু মিয়া নিজ খরচেই কোদাল, ছুরি, দা, করাতসহ কবর খোঁড়ার নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিতেন। আর সেগুলো নিয়েই বাহাদুরের পিঠে চেপে ছুটে যেতেন জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। যখনই কোনো কবর খুঁড়তেন, সেটি লিখে রাখতেন তার ডায়েরিতে। এমন মহৎ কাজের জন্য এলাকায় বেশ সুনাম রয়েছে মনু মিয়ার।
জানা যায়, নিজ স্ত্রীকে সবসময় সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি কিনে না দিলেও তার প্রিয় ঘোড়া বাহাদুরকে এসব কিছু কিনে দিতে কখনোই কালক্ষেপণ করতেন না।
গত শুক্রবার বাহাদুরের মৃত্যুর সংবাদ আসতেই শোকের ছায়া নেমে আসে তার এলাকাজুড়ে। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, মনু মিয়ার মৃত ঘোড়াটিকে শনাক্ত করতে যে তিনজন গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন এসএম রিজন।
রিজনের মতে, ছত্রিশ গ্রামে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন সেখানকার শাওন নামক এক ব্যক্তির একটি স্ত্রী ঘোড়া রয়েছে। ঐ ঘোড়াটিকে নাকি মনু মিয়ার ঘোড়া আঘাত করেছিল। আর সেজন্যই মনু মিয়ার ঘোড়াটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে শাওন। এরই ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বাহাদুর।
স্থানীয়রা জানান, মনু মিয়া কোথাও বেড়াতে গেলেও সেখান থেকে ছুটে আসতেন যখনই কারো মৃত্যুর খবর পেতেন। এমনকি অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও তিনি কবর খোঁড়ার কাজ বন্ধ করেননি। এই নিয়ে প্রথম দিকে স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি হলেও পরবর্তীতে এই কাজে স্বামীর নিষ্ঠা দেখে স্ত্রী রহিমা বেগমও তাকে উৎসাহ দিতেন।
এই নিয়ে সেখানকার প্রশাসনও মুখ খুলেন। তারা জানান, এমন একটি ঘটনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। উপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।