Bangla
2 years ago

হারানো পেশা 'ভিস্তিওয়ালা'র ইতিহাস

Published :

Updated :

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ব যতই প্রযুক্তির সাথে সাথে আধুনিক হচ্ছে, ততই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। ভিস্তিওয়ালা এমন একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা যা আমরা ইতিহাসের পাতাতেই ফেলে এসেছি কারণ বর্তমানে এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে।

বর্তমানে এই পেশা আমাদের কাছে রুপকথার মতো। ভিস্তিওয়ালা ব্যাপারটি কী, কেন হারিয়ে গেল, কেনই বা ছিল - এই ইতিহাস জেনে আসি চলুন।

আজকের যুগে খাবার পানির জন্য রয়েছে অসংখ্য উৎস। পানিকে পান উপযোগী করতে ব্যবহার করা হয় নানারকম ফিল্টার। খুব সহজেই আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাই খাবার পানি। কিন্তু একটা সময় পানির এরূপ সহজলভ্যতা ছিল না, ছিল না পানির পাইপের সুব্যবস্থা। তখন ছিল এই পেশা - 'ভিস্তিওয়ালা'।

পার্সি শব্দ 'বেহেস্ত' থেকে উদ্ভুত হয়েছে 'ভিস্তি'। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করে বেহেস্ত হলো নদী, ঝর্ণা দিয়ে সাজানো অপূর্ব সুন্দর একটা অতিপ্রাকৃত জগৎ। আর সেখানকার সুমিষ্ট পানি বয়ে এনে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় ভিস্তিওয়ালা। তৃষ্ণার্ত মানুষের মুখে সুমিষ্ট এই পানি তুলে দিয়ে যেন নবজীবন দান করে ভিস্তিওয়ালারা।

ধারণা করা হয় ভিস্তিরা এসেছিল আরব থেকে। তারা ছিলেন সুন্নি মুসলমান। ভারতবর্ষে এসেছিলেন মোঘলদের অনুসরণ করে। ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ভিস্তিদের আদিনিবাস বিহার বলে মনে করা হয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঢাকাতেও ছিল সুপেয় পানির অভাব। তখন পশুর চামড়ার ব্যাগই ছিল পানি বহনের একমাত্র মাধ্যম। আর সেই ব্যাগকে বলা হত 'মশক'।

মশক ভিস্তিরাই তৈরি করতেন। এগুলো মূলত ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। কোরবানির ঈদে ছাগল জবাই করা হলে সেরা চামড়া বাছাই করে তা দিয়ে মশক বানানো হতো। চামড়া থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে জীবাণু ও দুর্গন্ধ দূর করা হতো। ২০দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে শুকানোর পর চামড়াকে পানিরোধী করতে মহিষের চর্বি দিয়ে ঘষা হতো। তারপর মশক কারিগররা সাদা সুতার সাথে বিশেষ ধরনের মোম ব্যবহার করে মশক প্রস্তুত করতেন।

ভারতবর্ষের ভিস্তিরা বেশিরভাগই ছিল দলিত সম্প্রদায়ের। আর দলিত সম্প্রদায়কে 'অস্পৃশ্য' বলে বিবেচনা করা হতো। অথচ উঁচু শ্রেণির মানুষেরা পানির প্রয়োজন মেটাতো সেই অস্পৃশ্যদের পানি দিয়েই। তাদের সরবরাহ করা পানিই রান্না ও স্নানের কাজে ব্যবহার করা হতো।

প্রথমদিকে তারা এই পানি সরবরাহের কাজ সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকেই করতো। পরে তারা এটিকে আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। তথাপি কঠোর পরিশ্রম বিবেচনায় পারিশ্রমিক ছিল কম। চামড়ার মশক বহনের জন্য প্রচুর শক্তি ব্যয় হতো। দিনে ১০-১২ ঘন্টা ঘুরে ঘুরে উপার্জন হতো মাত্র ২০০/৩০০ টাকা।

ভিস্তিওয়ালাদের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৫৩৯ সালে শের খান বিহারসহ মোঘল অঞ্চলগুলো জয় করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আর এদিকে বাংলা জয় করে মোঘল সম্রাট হুমায়ুন এগিয়ে চলেছিলেন আগ্রা সম্মুখে।  এরমধ্যে যাত্রাপথে চৌসা নামক স্থানে শের খানের বিশাল বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন।

১৫৩৯ সালের ২৬ জুন সম্রাটের বাহিনী তাবুতে বিশ্রাম কালে শের খান আক্রমণ করেন। দিগ্বিদিক না ভেবে মোঘল সম্রাট গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। সম্রাট নদীতে প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা হলে ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয় ভিস্তিওয়ালা নাজিম। সম্রাটকে সাহায্য করতে ছুড়ে দেন খালি মশক, বেঁচে যান সম্রাট।

হুমায়ুন নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধার করার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভিস্তিওয়ালা নিজামকে একদিনের জন্য আগ্রার মসনদে বসান। ভিস্তিওয়ালা তার একদিনের শাসন স্মরণীয় করে রাখতে নিজের মশক টুকরো টুকরো করে কেটে তাতে সিল্ক ও স্ট্যাম্প লাগালেন, আর সেসব স্ট্যাম্পে তার নাম ও অভিষেকের তারিখ লিপিবদ্ধ করে মুদ্রা জারি করলেন।

বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া যায় ভিস্তিওয়ালাদের অস্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান, চিত্রশিল্পী হাশেম খানের সাহিত্যকর্মে পাওয়া যায় তাদের উপস্থিতি। সুকুমার রায় 'ন্যাড়া বেল তলা ক'বার যায়' কবিতায় ভিস্তিওয়ালাদের নিয়ে লেখেন,

"লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তার না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?
এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ ক'রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জুতা আবিষ্কার' কবিতায় আছে,

"তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে, একুশ লাখ ভিস্তি
পুকুর বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।"

ঢাকাতেও ভিস্তিওয়ালারা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ঢাকার ভিস্তিওয়ালাদের বলা হত 'সাক্কা'। ঢাকা পুরাণ থেকে জানা যায় এসময় ভিস্তিওয়ালাদের একটি সংগঠন ছিল। আর এই সংগঠন প্রধানকে বলা হতো 'নবাব ভিস্তি'। তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল।

পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি এলাকা ঢাকার ভিস্তিদের মূল আবাসস্থল ছিল। ১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারীতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেন। তারা সুন্নি মতাদর্শের হলেও মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে রাস্তা পরিষ্কাকার রাখত। লালবাগকেল্লায় তারা টমটমে চড়ে বড় বড় মশকে পানি দিয়ে আসতো।

ঢাকাই ছিল শেষ শহর যেখানে ষাটের দশক পর্যন্ত তারা ভিস্তিওয়ালাদের দেখা গেছে। তখন পথেঘাটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা জেলা কালেক্টরকে ১৫০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হতো পানির ব্যবস্থার জন্য।

পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে নবাব আব্দুল গণি এবং নবাব আহসানউল্লাহর যৌথ প্রচেষ্টায় চাঁদনীঘাটে স্থাপন করা হয় পানি শোধনাগার 'ঢাকা ওয়াটার-ওয়ার্কস'। তখনকার মুদ্রায় এর নির্মাণ ব্যয় ছিল প্রায় দুই লক্ষ টাকা। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় 'ওয়াসা' নির্মাণের ফলে আর সুপেয় পানির অভাব পড়েনি। এতে নগরের উন্নয়নের চাকা ঘুরলেও ভিস্তিদের কর্মযাত্রা সেখানেই থেমে যায়।

অবশ্য দিন বদলের হাওয়ায় ভিস্তিওয়ালারাও তাদের পুরনো রূপ ছেড়ে আধুনিক হয়েছেন। এখন ভিস্তিওয়ালা নেই তবে পানি সরবরাহের কাজটি ঠিকই আছে। সদরঘাট, ইসলামপুর, পটুয়াখালীর লোকজন এসব পানি সরবরাহকারীদের বলে 'ভারওয়ালা'। তারা পানিভর্তি টিনের জার বহন করে। ওয়াইজঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমির পাশে অবস্থিত কল থেকে পানি নিয়ে ভারওয়ালারা বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করে।

ভিস্তিরা প্রজন্ম পরম্পরায় রূপ বদলে নিজেদের পেশা ধরে রেখেছেন কিছুটা হলেও। তাদের সন্তানরা আধুনিক পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে অন্যান্য পেশা যোগ দিচ্ছে। আধুনিক সময়ে ভিস্তির প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করলে বলা চলে এটিই ছিল অনিবার্য পরিণতি, এবং এটি ভিস্তিদের জন্যই আশীর্বাদ।

tanjilatasnim180@gmail.com

Share this news