Published :
Updated :
হিপি বা হিপ্পিদের নাম বইয়ের পাতার সূত্র ধরে অনেকের কাছেই পরিচিত। সত্তরের দশকের পর থেকে বিভিন্ন লেখায় বাউণ্ডুলে অগোছালো হিসেবে হিপিদের কথা উঠে এসেছে বারবার। কিন্তু হিপি কারা, কেন-ই বা “বোতাম আঁটা জামার নিচে পোষমানা এ প্রাণ” চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে সব নিয়ম - কানুন - শৃঙ্খল পায়ে দলে নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেন তারা, তা নিয়ে হতে পারে বিস্তর আলোচনা।
হিপি বা হিপ্পি শুরু হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে। মূলত ১৯৬০-এর দশকের মধ্যবর্তীকালীন সময়ে হিপ্পি মুভমেন্ট ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠিত একটি যুব আন্দোলন এবং যা সময়ের সাথে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সব প্রথার বাইরে গিয়ে নিজেদের অবস্থানকে স্বাতন্ত্র্য দেয়ার লড়াই ছিল কিছু মানুষের। সে লড়াই আজো চলে আসছে, ভিন্ন রূপে, ভিন্ন অবয়বে।
‘৬০ ও ‘৭০ এর দশকের মার্কিন মুলুকের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার একটা বড় অংশ জুড়েই ছিল বস্তুবাদ ও ভোগবাদ। রাষ্ট্র ও সমাজের জীবনধারা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য – এইসবকিছুরই প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কাউন্টারকালচার বা বিপরীতমুখী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ডাক দেয় হিপ্পিরা। এই আন্দোলনের পূর্বসূরী বলা যেতে পারে পঞ্চাশের দশকের বিট জেনারেশনকে। বিট জেনারেশন শিল্প-সাহিত্যের সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল জোর গলায়, নিজেদেরকে পরিচয় দিতো “বিটনিক” হিসেবে। বিট জেনারেশনের ফলশ্রুতিতে বিশ্ব পেয়েছে কবি জ্যাক ক্যারুয়াক ও অ্যালেন গিন্সবার্গকে। তৈরি হয়েছে জ্যাজ সংগীত। কফিশপের হাত ধরে ধরে বিট কালচার ছড়িয়ে পড়েছে স্বমহিমায়।
বিট কালচারের বই, গান, চিন্তাধারা সবই তরুণ বুদ্ধিজীবীদের হাত ধরে তৈরি। সেগুলো যখন নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে, ধীরে ধীরে তখন জন্ম নেয় হিপি আন্দোলন। সানফ্রান্সিসকোর হেইট-অ্যাশবুরি, নিউইয়র্কের গ্রিনিউইচ ভিলেজ, লস এঞ্জেলেসের সানসেট স্ট্রিপ ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে মাদক এবং সংগীতের মিশেল।
ছবি: হিপিদের শুরুটা ছিল বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন (কালচার কালেক্টিভা)
একদিকে দ্যা বিটলস আর রোলিং স্টোনের মতো নতুন সময়ের নতুন স্রোতের গান, অপরদিকে সাইকাডেলিক মাদকের বিস্তার – এই দুই প্রথাবিরোধী চর্চা একাকার করে দিতে থাকে হিপি আন্দোলনকে। হিপিরা যুদ্ধের পরিপন্থী, তারা রাজনৈতিক পরিবর্তন চায়, প্রকৃতির সাথে একাত্মতায় মিশে যেতে চায়, ছড়িয়ে দিতে চায় শান্তি ও ভালোবাসার বার্তা। মূলধারার সমাজ যদিও তাদের এই প্রচেষ্টাকে ভালোভাবে দেখেনি কখনোই। বরং এইসব আন্দোলন শিশুসুলভ বলে চালিয়ে দেয়ার জন্যে হিপিদেরকে বলা হতো “ফ্লাওয়ার চাইল্ড”, আর হিপিদের কাছে প্রাপ্তবয়স্ক সমাজের নাম ছিল দ্যা ম্যান।
হিপি আন্দোলন মোটেও সুসমন্বিত ছিল না। ছিল না লিখিত ইশতেহার কিংবা একক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব; ছিল কেবল পরিবর্তনের জন্য হাহাকার আর কর্পোরেট-প্রভাব, ভোগবাদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের রক্তাক্ত অভিলাষ পরিত্যাগ করে সহজ ও শান্তিপূর্ণ জীবনধারায় ফিরে যাওয়ার সুতীব্র আকুতি। কয়েকজন হিপি একত্র হয়ে গড়ে তুলেছে নিজেদের অঞ্চলের মতো করে হিপি বিপ্লব। আফ্রিকান - আমেরিকান, হিস্পানিক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্রে হিপি আন্দোলন হয়ে উঠেছে ক্রমশ আকর্ষণীয়। সময়ের সাথে এই আন্দোলন হয়ে ওঠে সংগীত, সাইকোঅ্যাকটিভ ড্রাগস, যৌনস্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্র।
হিপ্পিরা সবসময়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচির পাশাপাশি ষাটের দশকে গড়ে ওঠা নব্য বামপন্থী বা নিউ লেফটিস্ট মুভমেন্টের প্রতি হিপ্পিরা ছিল সহানুভূতিশীল। হিপ্পিরা ভালোবাসায় বিশ্বাসী; তাদের রাজনীতিতেও বিদ্যমান অহিংস ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। হিপ্পিদের কণ্ঠে তাই উঠে এসেছে স্লোগান, “মেইক লাভ, নট ওয়ার।”
ছবি: হিপিদের ব্যবহৃত মাইক্রোবাস(স্টিমইট)
শুধু সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল হিপ্পিরা, এমনটা নয়। পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাথেও তাদের ছিল সংহতি। পরিবেশ রক্ষায় মানুষকে তৎপর করার যে দৃঢ় প্রত্যয় তাদের কাজেকর্মে আলোড়ন তোলে, মূলত তারই হাত ধরে ১৯৭০ এ প্রথম ধরিত্রী দিবস পালিত হয়েছিল। ভেগান ফুড অর্থাৎ প্রাণীজ উৎস থেকেও খাবার সংগ্রহ না করে নিরামিষাশী হওয়ার ধারণাটাও হিপ্পিদের উদ্ভাবন বলে দাবী করেন কেউ কেউ।
হিপ্পি আন্দোলন শুধু ইউরোপ আমেরিকাতেই আটকে ছিল, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। কাঙ্ক্ষিত শান্তি আর ভালোবাসার সন্ধানে হিপ্পিরা ছুটে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারতবর্ষে ১৯৭০ এর দশক থেকে হিপ্পিদের আনাগোনা শুরু হয়। কলকাতার রাস্তায় দলবেঁধে দেখা গেছে হিপ্পিদের। মাদকে বুঁদ হওয়ার বাইরেও ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং শান্তিপূর্ণ জীবন হিপ্পিদের টেনেছে প্রবলভাবে। সাইকাডেলিক মাদকের বিস্তারও যদিও এভাবেই ঘটে যায়।
হিপ্পিরা সমাজের সেই ব্যতিক্রমী প্রজন্ম, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেছে নিয়েছিল নতুন এক জীবনধারা। প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রীতিনীত, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি, রক্ষণশীলতা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি – সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা হয়েছিল ঘরছাড়া। সময়ের সাথে আন্দোলন হয়েছে স্তিমিত। কিন্তু মূলধারার স্রোতে যে প্রবল বিপরীতমুখী দোলা দিয়েছিল হিপ্পিরা, তার প্রভাব আজো ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। লম্বা ঝাঁকড়া চুল, রঙচঙে পোশাক, নিজের জীবন নিজের মতো করে সাজানোর আগ্রহ আজকের দিনের মানুষকে যে অনুপ্রেরণা জোগায়, তার পেছনে হিপ্পিদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পপ কালচারেও দ্যা গ্রেটফুল ডেড, দ্যা ডোরস, পিংক ফ্লয়েডের মতো ব্যান্ডদল গড়ে উঠেছিল, যারা এখনো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। আজো যারা প্রথা ভাঙতে চায়, স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চায়, স্যানফ্রান্সিসকোর সত্তরের দশকের কোনো এক তরুণ হিপ্পি তার মনে আজো আলো জ্বেলে চলছে।
sherajularifin@iut-dhaka.edu