Published :
Updated :
এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিখ্যাত মিষ্টান্ন দ্রব্য ‘গুড়’ একটি অপরিশোধিত চিনির পণ্য। আখ/তাল বা খেজুরের রস ছেঁকে নিয়ে বড় একটি পাত্রে তা ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে জ্বাল দিতে হয়। এতে রসের জলীয় অংশ বাষ্পীভূত হয়ে যায় এবং গাঢ় অংশ ঘনীভূত হয়ে গুড়ে পরিণত হয়।
সুন্দর খয়েরী রংটি-ও মূলত এসময়-ই ধারণ করে। খেজুরের গুড় বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বেশ সুস্বাদু। এছাড়াও নানান আকারে গুড়কে নানা নামে ডাকা হয়, যেমন: ঝোলা গুড়, ভেলি গুড়, চিটে গুড়, নলেন গুড়, পাটালী গুড়, হাজারী গুড়, ইত্যাদি। মিষ্টিজাত এই পণ্যটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এটি পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ।
গুড়ের তৈরী নানা পদের মধ্যে গুড়ের শরবত অন্যতম। সাধারণত পাটালী গুড় কিংবা তরল গুড়ের সহায়তায় এই শরবত প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। গুড়ে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি৬, সি, এবং খনিজ লবণ আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাংগানিজ, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস।
যদিও এই শরবত সারা বছর খাওয়া-ই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তবে রোযায় ইফতারে পানীয় হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়। যেহেতু সারাদিন রোযা রাখার পর মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্ত এবং বেশ তৃষ্ণার্ত থাকে, তাই তখন গুড়ের শরবত একই সাথে তৃষ্ণা মেটানো এবং পুষ্টির অভাব পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রস্তুত প্রণালি
শরবত প্রস্তুতের জন্য পরিমাণমত পানিতে খাটি গুড় মিশিয়ে নিতে হবে। এতে কিছুটা লবণ বা লেবুর রস চিপে নিলে স্বাদ বৃদ্ধি পায়। অনেকে পুদিনা পাতা কিংবা এলাচ-ও ব্যবহার করে থাকে স্বাদে ভিন্নতা আনার জন্য। সবশেষে বরফের টুকরো বা বরফ কুচি দিয়ে এটি পরিবেশন করতে হবে।
গুড়ের তৈরী শরবতের অন্যতম স্বাস্থ্যগত উপকার হলো খালি পেটে পান করলে এটি আমাদের পাকস্থলী পরিষ্কার করতে সক্ষম। এছাড়াও কোষ্টকাঠিন্য দূর হওয়া, এসিডিটি রোধ করা, বদহজম সারিয়ে তোলা, শরীর থেকে দূষিত পদার্থ দূর করে পেট, অন্ত্র, খাদ্যনালী ও কিডনি সুস্থ রাখা, মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করা এবং পানিশূন্যতা রোধ করায় গুড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কখনও কখনও ঠাণ্ডা-জ্বরের নিয়ামক হিসেবেও এটি কাজ করে থাকে। শরীর থেকে ক্ষতিকর দূষিত পদার্থ দূর করার অসাধারন ক্ষমতার জন্য গুড় কে ‘ন্যাচারাল ডিটক্সিফায়ার’ বা প্রাকৃতিক পরিশুদ্ধকারক বলা হয়ে থাকে।
খেজুর গুড়
সবচেয়ে জনপ্রিয় এই গুড়টি প্রস্তুত করতে হয় খেজুর রসকে জ্বাল দিয়ে। রঙে, গন্ধ এবং স্বাদে এটি অনন্য। যেহেতু শীতকালে মূলত এই গুড়টি আহরণ করা হয়ে থাকে, তাই হরেক রকমের পিঠা-পুলিতে এর ব্যবহার লক্ষণীয়। এছাড়াও খেজুর গুড় বা নলেন গুড়ের সন্দেশ এবং রসগোল্লা বেশ সুস্বাদু।
এতে উপস্থিত আয়রন রক্তশূন্যতা দূর করে, এবং ফলস্বরূপ নারীদের অনেক রোগের দাওয়াই হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও যাদের হজমে সমস্যা আছে তারা প্রতিদিন অল্প পরিমাণে খেজুর গুড় খাদ্যাভ্যাসে রাখতে পারেন। এতে আমাশয়, কোষ্টকাঠিন্য এবং হজমের মতো নাছোড়বান্দা রোগ-ও ধীরে ধীরে দূর হবে।
যেসব খাবার আমাদের লিভারের জন্য ভালো তাদের মধ্যে অন্যতম এই খেজুর গুড়। এতে খনিজ লবণ থাকায় আমাদের হাড়ের গঠন মজবুত করে, ত্বক ভালো রাখে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তচাপের সমস্যা দূর করে।
আখের গুড়
আখের রস থেকে প্রস্তুত এই গুড়টি-ও খেজুর গুড়ের মতো আয়রন সমৃদ্ধ। এটি শরীরে রক্ত উৎপন্ন করে, রক্ত সঞ্চালন তরান্বিত করে এবং শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এলার্জি ও মাইগ্রেনের ব্যথা সারাতে আখের গুড় বেশ পটু। আখের গুড়ে জিংক ও সেলেনিয়াম ধাতু থাকায় এটি ইমিউন সিস্টেম তথা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জন্ডিস রোগী ও ডায়রিয়া রোগীকে আখের গুড়ের স্যালাইন খাওয়ালে তারা দ্রুত বল ফিরে পায় এবং শরীরের প্রয়োজনীয় ঘাটতি পূরণ হয়।
খেজুর গুড় এবং আখের গুড়ের মধ্যেও আবার নানান রকম ও ধরন রয়েছে। খেজুর গুড়ের মধ্যে আছে নলেন গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড়, পাটালী গুড় ইত্যাদি। আখের গুড়-ও তেমনি তরল এবং কঠিন উভয় আকারেই পাওয়া যায়। এছাড়া রস জ্বাল দিয়ে চিনি বানানোর সময় একই প্রক্রিয়ায় দুবার জ্বাল দিলেই প্রস্তুত হয় ভেলি গুড়। এটিকে আরও ঘন করলে তৈরী হয় চিটে গুড়। এই দুই প্রকার গুড় ভিটামিন সমৃদ্ধ হলেও খেতে কিছুটা তিতে হয়ে থাকে, তাই এদের তেমন জনপ্রিয়তা নেই।
খাটি গুড় যেমনি শরীরের জন্য উপকারী, তেমনি ভেজালযুক্ত নকল গুড় এনে দিতে পারে নানা শারীরিক জটিলতা। ভেজাল গুড় দেখতে অবিকল আসলের মতো মনে হলেও, বাজার থেকে কেনার আগে কিছুটা যাচাই করে নিলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
নকল গুড় চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো কেনার সময় দুই আঙুলের চাপ দিয়ে একটু ভেঙে নিয়ে চেখে দেখা। যদি এটি নোনতা স্বাদের হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এই গুড়ে ভেজাল আছে।
khanpushpita11@gmail.com