Published :
Updated :
মানবজাতির ইতিহাসে পৃথিবী প্রায় ১০ হাজার যুদ্ধ দেখেছে। এসব যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত মানুষ। বন্দী হয়েছে বহু। যুদ্ধ ছাড়াও সন্ত্রাসীদের দ্বারাও মানুষকে বন্দী করার বা জিম্মি করার ইতিহাস পুরনো। ইংরেজি হোস্টেজ (Hostage) শব্দ দ্বারা এমন মানুষকে বোঝায় যে অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন দ্বারা বন্দী আছে।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এরকম অনেক ঐতিহাসিক বন্দী বিনিময় দেখতে পায় আমরা।
হামাস-ইসরায়েল বন্দী বিনিময়
গত ৭ অক্টোবর হামাস ইজরায়েলে রকেট হামলা চালায়। হামাস হামলার সাথে সাথে বেশ কিছু ইজরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে বন্দী হিসেবে নিয়ে আসে। প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল গাজায় অমানবিক আক্রমণ চালায়। ইজরায়েল কেবল অগণিত মানুষই (যাদের বেশিরভাগই শিশু) হত্যা করেনি, বন্দী করেছে অনেককে।
শুক্রবার মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে চার দিনের যুদ্ধ্ববিরতিতে সম্মত হয় ইজরায়েল ও হামাস। এই যুদ্ধবিরতি পরবর্তীতে একদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধবিরতিকালীন ১৫০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইজরায়েল এবং ৫০ জন বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস। চুক্তির ফলে ইতোমধ্যে হামাস ১৩ জন ইজরায়েলিসহ ২৪ জনকে মুক্তি দিয়েছে। বন্দীদেরকে হামাস রেড-ক্রসের হাতে হস্তান্তর করে। অন্যদিকে ইজরায়েল ৩৯ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে।
ইরান-ইউএসএ বন্দী বিনিময়
১৯৭৯ সালে ইতিহাসের অন্যতম ঘটনাবহুল বিপ্লব হয় ইরানে। আয়াতোল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে ইরানের তৎকালীন শাসক রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিপ্লবীরা। রেজা শাহ ছিলেন পশ্চিমা আদর্শ অনুসরণকারী শাসক।
খামেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর খামেনীপন্থী শিক্ষার্থীরা ইরানের মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে। প্রায় ৪৪৪ দিন মার্কিন কূটনৈতিকরা বন্দী থাকেন। এর মাঝে ২৪শে এপ্রিল ১৯৮০ সালে আমেরিকা জিম্মিদের উদ্ধারে অপারেশন ইগল ক্লজ নামে একটি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানটি ব্যর্থ হয়।
আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় ২০ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে আমেরিকার ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের শপথ নেয়ার দিন বন্দীদের মুক্তি দেয় ইরান।
হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল
লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সাথে ইজরায়েলের সংঘর্ষ বহু পুরনো। ২০০০ সালে এলহানান তানেবম (Elhanan Tannenbaum) নামে এক ইজরায়েলি ব্যবসায়ীকে কিডনাপ করে হিজবুল্লাহ। ২০০৪ সালে তানেবম ও আরো তিন ইজরায়েলী সৈন্যের মৃতদেহ ইজরায়েলকে হস্তান্তর করে হিজবুল্লাহ। বিনিময়ে ৪০০ ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ বন্দীকে মুক্তি দেয় ইজরায়েল। এই বন্দী বিনিময় মধ্যস্থতা করে জার্মানি।
আফগান-সোভিয়েত বন্দী বিনিময়
১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে এক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট নুর মোহাম্মদ তারাকী। ঠিক তার পরের বছরই হাফিজুল্লাহ আমিন তারাকীকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে নিজে রাষ্ট্রপতি হন। কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর সে বছর ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে অণুপ্রবেশ করে। প্রায় ১০ বছর ধরে চলা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে আফগানিস্তানের জন্য লড়াই করে মুজাহিদিনরা।
১৯৮৮ সালে সোভিয়েত নিজেদের সৈন্য ফিরিয়ে নেবার সিদ্ধ্বান্ত নেয়। সে বছরই ২০০ সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেয় মুজাহিদিনরা। বিনিময়ে ১ হাজার মুজাহিদিন সেনাকে মুক্তি দেয় সোভিয়েত। এই বন্দী বিনিময় আফগানিস্তানেরই একটি হাইওয়েতে অনুষ্ঠিত হয়।
শিমলা চুক্তি
১৯৭১ সালে যৌথ বাহিনীর কাছে প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। এত বিপুল সংখ্যক সৈন্যের আত্মসমর্পণের ইতিহাস বিরল। এত বিশাল সংখ্যক যুদ্ধ বন্দীকে হুট করে মুক্তি দেয়াও সম্ভব ছিল না। দফায় দফায় মতবিনিময়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ভারত-পাকিস্তান একটি চুক্তির মাধ্যমে দুই পক্ষের বন্দীদেরকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তিটি শিমলা চুক্তি নামে পরিচিত।
ইউএসএ-রাশিয়া
রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে বেশ কয়েকবারই বন্দী বিনিময় হয়েছে। এ দুই পক্ষের নিকটতম সময়ে বন্দী বিনিময়ের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। আমেরিকান বাস্কেট বল তারকা ব্রিটনি গ্রিনারের সাথে রাশিয়ান অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্টর বোটের বিনিময় সম্পন্ন হয়। এই বিনিময়টি দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে হয়।
এই দুই পক্ষের আরেকটি ঘটনাবহুল বন্দী বিনিময় ঘটে স্নায়ু-যুদ্ধের সময়। ১৯৬২ সালে আমেরিকান গোয়েন্দা পাইলট ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ারের সাথে রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) ইনটেলিজেন্স অফিসার রুডলফ ইভানোভিচ আবেলের বিনিময় ঘটে। এ ঘটনাকে উপজীব্য করে ২০১৫ সালে মুক্তি পায় ‘ব্রিজ অব স্পাইস’ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে খ্যাতনামা অভিনেতা টম হ্যাংকস অভিনয় করেন।
mizanur2351@gmail.com